
ফেসবুক সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম। এর কারণে সবাই পরস্পরের কত কাছাকাছি চলে আসে। চিন্তাচেতনা জানাশোনা জ্ঞানবিজ্ঞানের আদান-প্রদান ঘটে। মনের ভাবপ্রকাশ সহজেই দ্রুত করা যায়। কাছের লোকজন, বন্ধুবান্ধব সবার বর্তমান অবস্থান, অগ্রগতি, ভালো-মন্দ জানা যায়। বন্ধুরা বিশ্বের সেরা সুন্দর কোনো জলপ্রপাত বা ঝরনা দেখতে গেছেন, কয়েক মিনিটের মধ্যেই চোখের সামনে। লাইভ সেখান থেকে। আনন্দ-উল্লাসও ফেসবুকে মেলে। এ যেন প্রাইভেট কাম আধা পাবলিক মাধ্যম। যাতে অডিও-ভিডিও লাইভ সম্প্রচারসুবিধাও আছে।
এই মাধ্যম দিচ্ছে পরিচিতিও। অনেকেই এখন ফেসবুক তারকা। তাৎক্ষণিক লাইক, কমেন্টসের সুবিধা থাকায় যোগাযোগটা হচ্ছে একলহমায়। নানা রকম বিতর্ক, খুনসুটি; রসালো মন্তব্য, ফটো মন্তব্য, ফটো ব্যানার কত কিছুই না হচ্ছে ফেসবুকে। ঈর্ষা, হিংসা, বিদ্বেষও কম ছড়াচ্ছে না ফেসবুকের মাধ্যমে।
২.
একজন শিক্ষিত মেয়ে। একটি ছেলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল চার-পাঁচ বছর আগে। সম্পর্ক গভীর পর্যায়ে গিয়েছিল। হঠাৎ ছেলেটি সম্পর্ক অস্বীকার করে দূরে সরে যায়। মেয়েটি তখন মুষড়ে পড়ে। বছর খানেক হলো ছেলেটি ফিরে এসেছে। মেয়েটি আবার ওর মায়ায় জড়িয়ে পড়ে। এবার ছেলেটি ওর সঙ্গে ভিডিও তুলতে ও শেয়ার করতে বলে। মেয়েটি রাজি না হওয়ায় সে আবার সম্পর্ক অস্বীকার করে দূরে সরে যায়। আর ফেসবুকে আরেকটি মেয়েকে নিয়ে সমান তালে আড্ডার ছবি, ঘুরে বেড়ানোর বিভিন্ন ছবি দিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটি বলছিল আর কাঁদছিল। তার মনে হচ্ছে ওরা কত মজা করছে। ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর ওর মতো বঞ্চিত দুঃখী মানুষ এই পৃথিবীতে নেই। নিজেকে কুৎসিত অচ্ছুত ভাবছে। তার এখন কোনো কিছুই ভালো লাগে না। মরে যেতে ইচ্ছে করে।
৩.
দেশ-বিদেশের হাজার হাজার মাইল দূরত্ব এখন ঘুচে গেছে ফেসবুকের বদৌলতে। পেশা, জীবনের নিশ্চয়তা, বিচ্ছেদ ইত্যাদি নানা কারণে অনেকেই দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমান। একপর্যায়ে কারও কারও মনে হয় কী পেলাম এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে এসে। এখানে কাউকে কিছু দেখানোর নেই। আর কেউ দেখতেও চান না। সব দেখানোর জায়গা সেই নিজের দেশে। নিজের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এঁদের দেখাতে না পারলে মনে শান্তি কোথায়? তাঁরাই আগ্রহ ভরে দেখবেন। কেউ খুশি হবেন, আবার কেউ হিংসায় জ্বলে-পুড়ে মরবেন।
এমন একজনের কাহিনি। বিদেশ-বিভুঁইয়ে নিজের আত্মতুষ্টি প্রতিভা নিয়ে গর্বিত ছিলেন। কিন্তু সেটা কাউকে বোঝাতে বা দেখাতে পারছিলেন না। ফেসবুক তাঁকে সেই সুযোগ করে দিল। দেশের পরিচিত লোকজন, ফেসবুক বন্ধুরা কেউ তাঁকে সেভাবে প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়ে দিলেন না। তখন উনি খেপে গিয়ে যত্রতত্র মন্তব্য করা শুরু করেন। দেশের লোকজনের যোগ্যতা শিক্ষা মেধা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। রাতারাতি তিনি নাম কামিয়ে ফেললেন বাজে মন্তব্যকারী হিসেবে। ফেসবুকের বদৌলতে তিনি এখন পারসোনাল ডিসঅর্ডার বা পিডির রোগী। অথচ তাঁর বেসিক শিক্ষা এই দেশের মাটিতে হয়েছে। দেশের শিক্ষা দিয়েই ওখানে জীবনযুদ্ধে বেঁচে থাকার লড়াই করে চলেছেন। অথচ নিজের হীনম্মন্যতা উগরে দিচ্ছেন ফেসবুকে।
এমনটা হয়। ফেসবুকাসক্তদের সেই আক্ষেপ অনেকেরই জানা-লাইক, কমেন্ট পাওয়া খুবই কষ্টের। ফেসবুকাররা শাইলকের চেয়েও কৃপণ ও নিষ্ঠুর। ভাগ্যিস, ফেসবুক ডিসলাইক অপশন এখনো চালু করেনি।
এই সময়ের প্র্যাকটিসিং মনোরোগ চিকিৎসকেরা অনেকেই বলছেন, অতিরিক্ত ফেসবুকাসক্তি এখন মনোরোগে রূপ নিতে চলেছে। এমন অনেকের মুখোমুখি হচ্ছি এখন-মধ্যরাত, শেষ রাত অবধি মেতে রয়েছেন ফেসবুক নিয়ে। পাশে স্বামী বা স্ত্রী ঘুমাচ্ছেন। জীবনসঙ্গী তখন আলো নিভিয়ে হাতে ট্যাব বা আইপ্যাড নিয়ে অনন্ত অপেক্ষায়। সর্বশেষ যে ছবি বা স্ট্যাটাস যেটা দিয়েছেন, সেটায় কে কে আরও লাইক দিল। কেউ প্রশংসা বা টিটকিরি দিলে চটজলদি প্রতিক্রিয়া জানাতে যে হবেই।
মনের জটিলতা প্রকাশের পথ
মানুষ তার মনের জটিলতাকে বিভিন্নভাবে প্রকাশ করে। কেউ তাকে অস্বীকার করে। কেউ মনের মাঝে তালাবন্দী করে চেপে রাখে। আবার কেউ নিজের মনের অস্থিরতা জটিলতা অন্যের ওপর চাপিয়ে দিয়ে কথা বলে। কেউ ঝিকে মেরে বউকে শেখানোর মতো পথও বেছে নেন। সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সভ্য প্রমাণের জন্য মনের কুটকচালির বিষয়গুলো ছবি-গল্প-উপন্যাসের মাধ্যমে প্রকাশ করে। আর আজকের যুগে ফেসবুক সেই সুযোগ-সুবিধা সবার মাঝে সহজেই ছড়িয়ে দিতে পেরেছে।
মানুষের কতগুলো বেসিক চাহিদা থাকে-খাদ্য, নিরাপত্তা, শিক্ষা। আত্মমর্যাদা নিয়ে যোগ্যতার সঙ্গে জীবনযাপন সবার আকাঙ্ক্ষা। নিজের যোগ্যতা-মেধা-প্রতিভা প্রকাশের সুযোগ সবাই চায়। কিন্তু সমস্যা তখনই বাধে যখন সবকিছুতে বাধা আসে। আর তখনই কেউ মুষড়ে পড়ে। আর কেউ মনে যা আসে, হুজুগে তেমন উদ্ভট আচরণ করে বসে।
জটিলতা থেকে রক্ষার উপায়
* কাজে ব্যস্ত থাকুন। জীবনের উদ্দেশ্য ঠিক করুন।
* যা করছেন বা করতে চাইছেন সেটা পুনর্মূল্যায়ন করুন।
* ফেসবুক কেবল জটিলতা বাড়াচ্ছে না। মনকে হালকাও করে দিচ্ছে।
* আগে মনের ভাব প্রকাশের সুযোগ ছিল সীমিত। আড্ডা, গালগল্প, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, নানা পার্টি ছিল। এখন সেসব আছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ফেসবুক মিডিয়া। এই নবমিডিয়ার ইতিবাচক সুবিধা নিতে হবে। ফেসবুক আদবকেতা বা সোশ্যাল মিডিয়া এটিকেট ভুলে গেলে চলবে না।
* আপনি প্রশংসা পেতে চাইলে অন্যজনের ভালো কাজের প্রশংসা করুন। লাইক দিন। অভিনন্দন জানান। মনে রাখবেন, প্রশংসা সবার মনের আত্মতৃপ্তি।
* নিজেকে বঞ্চিত ভাববেন না। কারও নিন্দায় বা মন্দ মন্তব্যে ভেঙে পড়ার কিছু নেই। সবকিছু সহজভাবে নিন। পর্যালোচনার চেষ্টা করুন, কেন মন্দ মন্তব্য। সেটা থেকে শেখার চেষ্টা করুন। বলা হয়, অন্যের সমালোচনা হলো নিজের দোষত্রুটিকে চেনার মোক্ষম উপায়।
* যদি কারও কটু মন্তব্য আপত্তিকর হয়, তাকে এড়িয়ে চলুন। ইতিবাচক ও নিরপেক্ষ বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ান।
* ফেসবুক একটি সামাজিক মাধ্যম। একটি চলন্ত বই। একে ইতিবাচক, কল্যাণের কাজে ব্যবহার করুন।
* দেশ-বিদেশে যেখানেই থাকুন না কেন মাতৃভূমির অবদান ভুলে যাবেন না। মনকে বড় করুন। অন্যকে সম্মান করতে শিখুন। নিজেই তখন সম্মানিত হবেন।
* বিদেশে যে বন্ধুটি অক্লান্ত পরিশ্রম করে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছেন, তার মূল্যায়ন করুন। তার ভালো কাজের প্রশংসায় কার্পণ্য করবেন না। মনে রাখবেন, আপনার প্রবাসী বন্ধুর কাছে আপনার প্রশংসা, অভিনন্দন সোনার অক্ষরে লেখা চিঠির মতো। তাঁকে বঞ্চিত করবেন না।
* কাউকে পছন্দ না হলে তাঁকে সহজেই আপনি আনফলো বা ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে বাদ দিতে পারেন। অযথা মনোজটিলতা বাড়িয়ে আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না।
সুলতানা আলগিন, সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা