ফ্যাশনসচেতন আমার বীর বাবা

২০১৪ সালে অধুনার স্টাইল বিভাগের ফটোশুটে ফিটফাট শাহ্জামান মজুমদার (১৯৫৬–২০২০)ছবি: অধুনা

২ ডিসেম্বর বাবা চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। এই মাস বাংলাদেশি প্রত্যেকের জন্যই বিশেষ। তবে একজন বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধার কাছে নিশ্চয় আরও বিশেষ!

বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহ্জামান মজুমদার শুধু আমার বাবাই নয়, তিনি আমার কাছে একজন সত্যিকার সুপারহিরো। যে হিরো একাত্তরে দেশের প্রয়োজনে রণাঙ্গনে ছিলেন, লড়াই করেছেন দাপটের সঙ্গে। যে হিরো ফ্যাশন–সচেতন, যে হিরো ভালোবাসতেন স্বাধীনতায় বাঁচতে।

ছোটবেলা থেকে বাবাকে দেখেছি সব সময় ফিটফাট থাকতে। আর মনে মনে তাঁকে অনুসরণ করেই সামনে এগিয়েছি। বাবা সব সময় নিজের মর্জিমাফিক চলতেন। পৃথিবীর বিচিত্র বিষয়ে ছিল তাঁর শখ। এই যেমন ছোটবেলা একবার দেখলাম হঠাৎ বাসাভর্তি রং-তুলি, ইজেল আর ক্যানভাস। তিনি ছবি আঁকতে শুরু করলেন। এর আগে কয়েক মাস ধরে ছবি আঁকার নানা বিষয় নিয়ে চলেছে তাঁর পড়াশোনা। তবে সেসব ছবি কিন্তু ফেলনা নয়, দারুণ একেকটা ছবি আঁকতে থাকলেন। একটানা কয়েক মাস ধরে চলল বাবার এই শখের লালন-পালন। এরপর হঠাৎ নাই হয়ে গেল সেই শখ। সেই যে নাই হলো, আর কখনো রং-তুলি ছুঁতে দেখিনি তাঁকে।

বাবা কাজ করেছেন তথ্যপ্রযুক্তি খাতে। বছর তিনেক আগে অবসর নেন থাকরাল ইনফরমেশন সিস্টেম প্রাইভেট লিমিটেড থেকে। অনেক বছর কাজ করেছেন আইবিএমে। ছিলেন বাংলাদেশে আইবিএমের কান্ট্রি ম্যানেজার। কাজের সূত্রে নানা দেশে যেতেন। সিঙ্গাপুরে প্রায়ই যেতে হতো তাঁকে। অনেক বছর আগে তাঁকে পেয়ে বসল কম্পিউটার গেমের শখে। আমার জন্য তিনি সিঙ্গাপুর থেকে কিনে আনতেন নানা রকম গেম। আমরা দুজনে মিলে সেগুলো খেলতাম।

কেতাদুরস্ত ছেলে–বাবা—সেজান মজুমদার ও শাহ্জামান মজুমদার
ছবি: সংগৃহীত

আমাদের কোনো বিষয়ে শেখানোর জন্য তাঁর কৌশলও ছিল মজার। আমি যখন প্রথম ঘড়ি দেখা শিখি, সেটাও বাবার কাছে। নানাবাড়ির দেয়ালে একটা বড় আকারের ঘড়ি দেখিয়ে তিনি আমাকে শেখাতে লাগলেন ঘণ্টা, মিনিট, সেকেন্ডের হিসাব। আমি যতই অধৈর্য হই, তিনি হাল ছাড়েন না। নানা কৌশলে আমাকে শিখিয়েই ছাড়লেন!

বাবার স্যুট, টাই, ঘড়ি, জুতার সংগ্রহ দেখলে যে কেউ অবাক হবেন। স্যুটের প্রতি ভালোবাসা থেকে তো পাঁচতারকা হোটেল সোনারগাঁওয়ে ড্যাপার নামে একটা দোকানই চালু করলেন। বছরের পর বছর তিনি পড়াশোনা করেছেন ছেলেদের ফ্যাশন, স্টাইল আর স্যুটের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে। ড্যাপার নিয়ে তাঁর ভালোবাসার কারণেই চলতি বছর বনানীর ১২ নম্বর রোডের ৪৪ নম্বর বাড়িতে এর নতুন একটি শাখা চালু করি আমরা। বাবা ছেলেদের ফ্যাশন বিষয়ে পরামর্শ দিতে চালু করেন ফ্যাশন ব্লগ কিং অব ঢাকা (www.kingofdhaka.com)।

অধুনায় প্রকাশিত শাহ্জামান মজুমদারের প্রতিবেদন

রান্নার প্রতি আগ্রহ হলো একবার। তিনি ইন্টারনেট ঘেঁটে শিখতে লাগলেন দেশ-বিদেশের নানা রকম রান্না। বাসায় কিনে আনতে শুরু করলেন নানা রকম মসলা, সস আর উপকরণ। এরপর একটানা কয়েক মাস অফিস থেকে বাসায় ফিরেই রান্নাঘরে চলে যেতেন। আরেকবার মেতে উঠলেন সাবান বানানোয়। পরিবারের সদস্য থেকে পোষা কুকুর—সবার জন্য আলাদা সাবান বানাতেন। এই সাবান বানানোর আগেও তিনি করেছিলেন বিস্তর পড়াশোনা। আমাদের দুই ভাই–বোনকে (বোন ফারিজা মজুমদার) বাবা বড় করেছেন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি আমাদের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিতেন। কোনো বিষয় চাপিয়ে দেওয়ার অভ্যাস ছিল না তাঁর। তবে বাবা তাঁর যুদ্ধের গল্প খুব একটা বলতেন না, সেটা আমাদের সঙ্গেও। মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অংশগ্রহণ আমরা বেশির ভাগ জেনেছি বই পড়ে। ইংরেজিতে তাঁর লেখা দ্য গেরিলা বইটার বাংলা সংস্করণের কাজ করছিলেন এ বছর করোনার সময় ঘরে বসে। তাঁর খুব ইচ্ছা ছিল, দ্রুত বইটার কাজ শেষ করে প্রকাশ করবেন। দ্য গেরিলা বাংলায় লেখার আগে তাঁকে দেখেছি নিজের বাংলা ভাষার দখল বাড়াতে নানা রকম বই পড়ছেন। কোনো বিষয়ে তিনি দায়সারাভাবে শেষ করতে চাইতেন না। যেটা করবেন, সেটা পরিপূর্ণ হওয়া চাই।

শেষ তিন বছর কিডনি জটিলতায় অসুস্থ ছিলেন বাবা। ২০১৯ সালে তাঁর কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে আক্রান্ত হলেন ডেঙ্গু জ্বরে। সেরেও উঠলেন। বাসায় ফিরে আবার অসুস্থ হলেন, হাসপাতালে নেওয়া হলো। তবে এবার আর ফিরলেন না আমার সুপার হিরো।

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহ্জামান মজুমদার, বীর প্রতীকের ছেলে

অনুলিখন: হাসান ইমাম