বছরে কোটি টাকার কাজ করেন ‘গৃহিণী’

গৃহিণীরা ভালো থাকলে ভালো থাকবে পরিবার, ভালো থাকবে দেশছবি: সংগৃহীত
সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে—এ–জাতীয় চর্বিতচর্বণ তো হরহামেশাই আমরা চারপাশে শুনতে পাই। কিন্তু রমণী নিজে সুখে না থাকলে কীভাবে সবাইকে সুখে রাখবেন, সেটা ভেবে দেখার বিষয়।

গৃহিণী শব্দটিকে ইংরেজিতে ‘হোমমেকার’, ‘স্টে অ্যাট হোম মাম’, ‘ফুলটাইম প্যারেন্ট’—যে নামেই ডাকা হোক না কেন, সারা বিশ্বেই কমবেশি এই গৃহিণীরাই আদিকাল থেকে এখন পর্যন্ত ঘরের সব কাজের দায়িত্বে থাকেন। বিশ্বব্যাপী সরাসরি অর্থনৈতিক কাজে জড়িত আছেন ৩৬ শতাংশ নারী।

বাকি ৬৪ শতাংশ নারী যে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখেন না, এটা ভাবা মহাভুল। মার্কিন গবেষণায় উঠে এসেছে, বাড়িতে প্রত্যেক গৃহিণীর বাৎসরিক কাজের মূল্যমান ১ লাখ ১৭ হাজার ডলার বা এক কোটি টাকার বেশি। ২০২১ সালে চীনের এক আদালত যুগান্তকারী এক রায়ে একজন গৃহিণীকে তার ‘আনপেইড লেবার’ বাবদ সাড়ে ছয় লাখ রেনমিনবি (চীনের মুদ্রা) বা ৮৮ লাখ টাকা পরিশোধ করতে বলা হয় তাঁর সাবেক স্বামীকে। গৃহিণীরা আমাদের সমাজের বিশাল এক কর্মশক্তি। উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত—সব শ্রেণির পরিবারেই নারীদের একটা বড় অংশ গৃহিণী হিসেবেই জীবিকা নির্বাহ করেন। সারা বিশ্বেই গৃহিণীর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা ও স্বস্তির নানা উপায় নিয়ে বিস্তর গবেষণা ও লেখালেখি হয়। আমাদের দেশেও এই চরম অবহেলিত ও উপেক্ষিত বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বসহকারে ভাবার সময় এসে গেছে।

পারিবারিক ও সামাজিক স্বীকৃতি

সেলাই, মেরামতি, বাচ্চাদের পাঠদান, কাপড় ইস্ত্রি, ঘরের বাজারসদাই, গৃহ ব্যবস্থাপনা—কী করেন না গৃহিণীরা, সেটাই প্রশ্ন। সরাসরি তাঁদের কাজের উপযুক্ত বেতন পরিশোধ না করলেও সঠিক স্বীকৃতি আর প্রাপ্য সম্মানটুকু অবশ্যই আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। ‘আমার স্ত্রী কিছু করেন না’, ‘মা কিছু করেন না’, ‘মা বাসায় থাকেন’—এসব মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে এখনই। নয়তো গৃহিণীর ভালো থাকা আমরা কখনোই নিশ্চিত করতে পারব না।

গৃহকর্মে সবার অংশগ্রহণ

ঘরের সব কাজ শুধু গৃহিণীরাই করবেন, এই অযৌক্তিক নিয়ম বদলে ফেলার দিন এসেছে। বাস্তবসম্মত চিন্তার নিরিখে ঘরের সব কাজ গৃহিণীর পক্ষে একা করা খুবই দুরূহ। দিনে ঘরের কাজ, সারা রাত ছোট শিশুর দেখভাল, এমন অমানবিক জীবন কখনোই কোনো মানুষের প্রাপ্য নয়। সবাই মিলেমিশে গৃহিণীর তত্ত্বাবধানে ঘরের কাজগুলো করলে একদিকে যেমন গৃহিণীর কায়িক শ্রম কিছুটা লাঘব হয়, তেমনি পারিবারিক সম্পর্কগুলোও আরও গাঢ় হয়। গৃহিণীর কাজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিও বদলায়। বিশেষত বাড়ির শিশুদের এই ব্যাপারে ছোটবেলা থেকেই উদ্বুদ্ধ করা উচিত।

গৃহিণীর পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিতকরণ

প্রায় সময়ই দেখা যায়, বাড়ির সবাইকে মাছ–মাংসের বড় টুকরাগুলো দিয়ে বাড়ির গৃহিণীরা যা বেঁচে থাকে, তা দিয়ে দুটো ভাত খেয়ে নেন। এতে করে বেশির ভাগ সময় তাঁরা অপুষ্টিতে ভোগেন। সব সময় মাছ–মাংস না খেতে পারলেও খাদ্যতালিকায় অপেক্ষাকৃত সুলভ মূল্যের ডিম, ডাল, ছোলা ইত্যাদি আমিষজাতীয় খাদ্য, ভিটামিন ও মিনারেলে ভরপুর শাকপাতা, কচু, মৌসুমি ফল ও সবজি অবশ্যই রাখতে হবে। বিশেষ করে গর্ভবতী, সদ্য প্রসূতি ও স্তন্যদানকারী মায়েদের জন্য খাবারের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চল্লিশোর্ধ্ব গৃহিণীরা নিয়মিত ক্যালসিয়ামযুক্ত মৌসুমি ফল খেলে অল্প বয়সে ব্যথা ও হাড় ফাঁপা হয়ে ভেঙে যাওয়ার মতো রোগ থেকে মুক্ত থাকবেন।

প্রতিদিন নিজের জন্য কিছু সময়

বিষয়টি আমরা একেবারেই অবহেলা করি। কিন্তু দিনের অল্প কিছু সময় নিজের মতো করে, নিজের শখের কাজ বা ভালো লাগে এমন কিছু করতে পারলে গৃহিণীর মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য তা অত্যন্ত উপকারী। নিশ্চিন্তে নিজের পছন্দের গান শোনা, বাইরে গিয়ে প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটানো, বই পড়া, ব্যায়াম বা রূপচর্চা—পছন্দসই যেকোনো কিছুই করা যেতে পারে। এই কর্মবিরতি গৃহিণীর শরীর–মন সজীব সতেজ করে তোলে। নিজের কাজগুলো আরও ভালোভাবে ও উদ্যম নিয়ে করার জন্য তৈরি করে।

অর্থনৈতিক কাজে যুক্ত হওয়া

গৃহকর্মে সরাসরি অর্থ উপার্জিত না হলেও অর্থনীতিতে এর বড় ভূমিকা আছে, এমনটি সব অর্থনীতিবিদই বলছেন। কিন্তু তারপরও নিজের উপার্জিত কিছু অর্থ নিজের মুঠোয় থাকলে তা সামাজিক ও জাতীয় ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়নে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে। ঘরে থেকেই ছাদে বা উঠোনে সবজিবাগান করে, ফুলগাছ, ক্যাকটাসের নার্সারি বানিয়ে, হাঁস–মুরগি বা ছাগল পালন করে কিছু অর্থ আয় করা গেলে তা গৃহিণীর মনে একধরনের আত্মবিশ্বাস জোগাবে, যা পরিবারের জন্যও কল্যাণকর। বিভিন্ন শখের কাজ, সূচিকর্ম, চারু ও কারুশিল্পের মাধ্যমেও আয়রোজগার সম্ভব। বর্তমান যুগে তো গৃহিণীদের অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্মের সহায়তায় সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে মেলে ধরছেন। ফ্রিল্যান্সিং বা ওয়েব কনটেন্ট তৈরি করাতেও পিছিয়ে নেই নারীরা।

সৃজনশীল শখের কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করা

অবসর সময়ে শুধু টেলিভিশন দেখা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ফোনে আলাপচারিতায় না কাটিয়ে নিজের সুকুমারবৃত্তিগুলোকে বিকশিত করার চেষ্টা করলে গৃহিণীদের একঘেয়ে জীবনে আসবে নবোদ্যম। জোগাবে নতুন মাত্রা। বাগান করা, ছবি আঁকা, ঘর সাজানোর ক্র্যাফটসামগ্রী তৈরি, শৌখিন সূচিকর্ম, ক্যালিগ্রাফি, লেখালেখিসহ আরও বহু ধরনের সৃষ্টিশীল কাজ আছে। শখের কাজ হিসেবে এগুলো অত্যন্ত প্রশান্তিদায়ক। এ ছাড়া শিশু লালন, রন্ধনশিল্প, বেকিং, কম্পিউটারশিক্ষা, শিশুশিক্ষা, ফটোগ্রাফির ওপর ছোটখাটো কোর্স করলেও তা গৃহিণীদের দক্ষতা, জ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনে সহায়ক হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এর মাধ্যমে নিজের গণ্ডি বড় হবে।

শরীরচর্চা ও ব্যায়ামে মনোযোগী হওয়া

সারা দিন ঘরে থেকে এটা–সেটা করলেও সেভাবে শরীরচর্চার দিকে গৃহিণীরা প্রায়ই অমনোযোগী থাকেন। প্রসব–পরবর্তীকালে হরমোনের অসামঞ্জস্যতার ফলে শরীরে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ওজন বেড়ে যেতে পারে। তখন দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। বাতের ব্যথা, হৃদ্‌রোগ, ডায়াবেটিস, অস্বাভাবিক স্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ, মানসিক অবসাদ ইত্যাদি সব প্রাণঘাতী ও কষ্টদায়ক রোগ প্রতিরোধ করতে পারে পর্যাপ্ত ব্যায়াম। ঘরে বসে যোগব্যায়াম করা বা বাইরে গিয়ে হেঁটে আসা, ঘরের কায়িক শ্রমের কাজগুলো নিজে করা ইত্যাদি নানাভাবেই আমরা দৈনিক শরীরচর্চা সেরে ফেলতে পারি।

নারী দিবসের এই সময়ে গৃহিণীদের ভালো থাকার ব্যাপারে সবার সম্মিলিত সচেতনতা তৈরির বিকল্প নেই। গৃহিণীরা ভালো থাকলে ভালো থাকবে পরিবার, ভালো থাকবে দেশ—এটুকু বুঝে নেওয়ার এখনই সময়।