বনস্পতির ছায়া
>সামনে বাবা দিবস। দিনকে উপলক্ষ করে নয়, বয়স্ক বাবাকে শত ব্যস্ততার মধ্যে সময় দিতে হবে। নিতে হবে তাঁর মনের খবর।

গ্রিক চলচ্চিত্রকার কনস্টানটিন পিলাভিয়োস হোয়াট ইস দ্যাট নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। সেখানে দেখা যায়, একজন বৃদ্ধ বাবা বাগানের বেঞ্চে বসে আছেন, পাশে তাঁর যুবক সন্তান পত্রিকা পড়ছে। একটি পাখি উড়ে এসে ঝোপে বসতেই বাবা জিজ্ঞাসা করেন, ‘ওটা কী?’ ছেলে উত্তর দেয়, ‘চড়ুই পাখি’। বাবা একটু পর পাখির নড়াচড়া দেখে আবার জিজ্ঞাসা করেন, ‘ওটা কী?’ ছেলের উত্তর, ‘চড়ুই পাখি’। এভাবে দু-একবার একই প্রশ্ন-উত্তর চলার পর ছেলে খুব বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে জবাব দেয়, ‘চ-ড়ু-ই পা-খি’ বানান করে সে জানায় বাবাকে। আর রাগ করে বলে, ‘কতবার বলছি যে ওটা চড়ুই পাখি—চড়ুই পাখি—চড়ুই পাখি, কেন তুমি বোঝো না।’ বৃদ্ধ বাবা আস্তে আস্তে উঠে ঘরে চলে যান। ফিরে আসেন তাঁর পুরোনো ডায়েরিখানা নিয়ে। সেখান থেকে তিনি ছেলেকে পাঠ করতে দেন পুরোনো লেখা—‘আমার ছেলের বয়স মাত্র তিন বছর। ওকে নিয়ে পার্কে এসেছি, একটি চড়ুই পাখি দেখে সে বারবার জিজ্ঞাসা করছে—ওটা কী? এভাবে সে ২১ বার জিজ্ঞাসা করল, আমি ২১ বার তাকে জানালাম ওটা চড়ুই পাখি। প্রতিবার আমার নিষ্পাপ শিশুর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় আমি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে থাকলাম।’ ছবিটিতে দেখা যায়, বাবার পুরোনো ডায়েরি পড়ে যুবক ছেলেটি চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি, পরম মমতায় বাবাকে বুকে টেনে নিয়েছে।
একজন মানুষ যখন বৃদ্ধ হন, কর্মজীবন থেকে অবসরে যান, তখন নানা রোগ তাঁকে কাবু করে ফেলে, কখনো-বা তিনি একাকী হয়ে পড়েন। সে সময় বয়সজনিত পরিবর্তন আর প্রজন্ম ব্যবধানের কারণে তাঁর চারপাশের ধারণার জগৎ সন্তানদের চেয়ে খানিকটা আলাদাই থাকে। হয়তো তিনি একই কথা কয়েকবার বলে ফেলেন বা তুচ্ছ জিনিস নিয়ে উৎকণ্ঠিত হন। বাৎসল্যবোধের প্রাবল্য কিন্তু তাঁর কমে না। সন্তানের মঙ্গল কামনায় তিনি সব সময়ই সচেষ্ট! সন্তানেরা অনেক সময় তাঁর মনের ভাষা বুঝতে পারে না, ভুল বুঝে তাঁর ওপর বিরক্ত হয়। কখনো বন্ধুবান্ধবীদের সামনে বৃদ্ধ বাবার আচরণে বিব্রতবোধ করে এবং তাঁকে সবার সামনে আসতে নিরুৎসাহিতও করে।
বৃদ্ধ বয়সে কেউ কেউ ডিমেনশিয়া বা আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত হন। তাতে স্মৃতিশক্তি কমে যায়। আবেগ, অনুভূতি, বিবেচনাবোধ, কাজ করার ক্ষমতায় পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তনটা সন্তানেরা মাঝেমধ্যে সহজভাবে নিতে পারে না। সন্তানের মননে বাবার যে রাশভারী, দাপুটে চরিত্র স্থান করে নিয়েছে, সেখানে এই খানিকটা শিশুতোষ আচরণ মেনে নিতে তার কষ্ট হয়। সেখান থেকেই বিরক্তি আর বিরক্তি থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত কর্কশ আচরণ। তবে শুধু বোঝার ভুল থেকে নয়, অনেক সময় কোনো কোনো সন্তান বৃদ্ধ বাবাকে তাদের পরিবারে বোঝা মনে করে। বাবার চিকিৎসায় অবহেলা থেকে শুরু করে তাঁর সঙ্গে ঝাঁজাল স্বরে কথা বলা—এমনকি কখনো তাঁকে শারীরিকভাবে পীড়নের ঘটনাও ঘটে।
সন্তানের প্রতি বাবার অপত্য স্নেহ একসময় গড়িয়ে চলে যায় নাতি-নাতনির দিকে। সেখানেও তিনি অনেক সময় যেন অপাঙ্ক্তেয়। তিনি যেভাবে নাতি-নাতনিকে গড়ে-পিটে নিতে চান, তাঁর নিজের সন্তানেরা সেটাকে মনে করেন ‘পুরোনো ভাবনা’। তৈরি হয় একধরনের মানসিক দ্বন্দ্ব আর সেখান থেকে চক্রাকারে আবার বাবার প্রতি অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ।

সন্তানদের অনুযোগ থাকে, বাবা কিছু বুঝতে চান না। এ নিয়ে তারা নানাজনের কাছে অভিযোগ করে।
আবার কারও অনুযোগ থাকে, বাবা সবকিছুতে বেশি বোঝেন, আগ বাড়িয়ে নাক গলান। অনেক সময় একই কথা একাধিকবার বলার কারণে সন্তানেরা মনে করে বাবা অপ্রয়োজনীয় কথা বলেন বেশি। এ জন্য তাঁকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে রাখে। নানা জায়গায় নানাভাবে বৃদ্ধ মানুষটি ঝামেলা তৈরি করেন বলে সন্তানেরা মনে করেন। নিজেদের কোনো আলোচনায় বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সন্তান বাবাকে এড়িয়ে চলে। ভাবে, বাবা এখানে একেবারে অকেজো একটা মতামত চাপিয়ে দেবেন। বৃদ্ধ বাবার অনিচ্ছাকৃত কোনো দুর্ঘটনা—যেমন চশমা হারিয়ে ফেলা, গ্লাস ভেঙে ফেলার মতো তুচ্ছ বিষয় নিয়েও সন্তানেরা বিরূপ আচরণ করে থাকে।
একজন মানুষ যখন বৃদ্ধ হন, তখন তাঁর প্রতি আরও বেশি মমতাময় আচরণ করা উচিত। এ সময় কাজ থেকে অবসর নিয়ে, কখনো জীবনসঙ্গীকে হারিয়ে এবং নানা রোগের কারণে তিনি খানিকটা বিহ্বল আচরণ করতেই পারেন। সেটাতে বিরক্তি প্রকাশের কোনো অবকাশ নেই। ছোটবেলায় তিনি পরম মমতায় আগলে রেখেছিলেন তাঁর সন্তানকে, তিল তিল করে বড় করেছেন, হাত ধরে চলতে শিখিয়েছেন, পাতের মাছ বেছে খাইয়েছেন, বুকে আগলে রক্ষা করেছেন শত ঝঞ্ঝা থেকে, আয়ের সবটাই ব্যয় করেছেন সন্তানের জন্য। ফলে বিরক্তিকর মুখ ঝামটা তাঁর কখনোই প্রাপ্য হতে পারে না।
আজ বাবা বৃদ্ধ হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু সারা জীবন বনস্পতির ছায়ায় লালন করেছেন নিজের সন্তানকে। কবীর সুমনের ভাষায়, ‘তিনি বৃদ্ধ হলেন, বৃদ্ধ হলেন/বনস্পতির ছায়া দিলেন, সারা জীবন।’
বয়স্ক বাবার প্রতি কেমন হবে সন্তানের আচরণ
* বাবাকে বুঝতে হবে, তাঁর মনের ভাবনাগুলো পড়তে হবে।
* মনে রাখতে হবে, তাঁর সব আচরণের উদ্দেশ্য সন্তানের মঙ্গল কামনায়।
* বাবাকে সামাজিক অনুষ্ঠানে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে।
* নাতি-নাতনির সাহচর্য থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।
* পারিবারিক বা ব্যক্তিগত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর মতামত জানতে হবে।
* তাঁর কোনো আবেগের স্থান বা বস্তু নিয়ে ব্যঙ্গ, তাচ্ছিল্য করা চলবে না।
* বাবার কোনো ওষুধ থাকলে সেটার দিকে নজর রাখতে হবে এবং ওষুধ খেয়েছেন কি না খবর রাখতে হবে। ওষুধ খেতে ভুলে গেলে রাগ করা চলবে না।
* মা-বাবাকে একসঙ্গে রাখতে হবে, নিজেদের সুবিধার জন্য তাঁদের আলাদা করা যাবে না।
* কখনো তাঁর কোনো সিদ্ধান্ত ভুল মনে হলে, বিনয়ের সঙ্গে জানাতে হবে বা কৌশলে সেটি মোকাবিলা করতে হবে, এ নিয়ে উত্তেজিত হওয়া যাবে না।
* বাবাকে কেন্দ্র করে মাঝে মাঝে পারিবারিক সম্মিলনীর আয়োজন করা যেতে পারে, তার কর্মময় জীবনের জন্য তাঁকে প্রশংসিত করতে হবে।
* পরিবারের ছোটখাটো হালকা কাজের দায়িত্ব তাঁকে দিতে হবে, যাতে তিনি কখনোই নিজেকে অকেজো মনে না করেন।
* তাঁর শোবার ঘর, শৌচাগার ইত্যাদিতে যাতে হাঁটতে-চলতে কোনো অসুবিধা না হয় সে জন্য যতটুকু সম্ভব ব্যবস্থা করতে হবে।
* কোনো অবস্থাতেই রূঢ় আচরণ করা যাবে না।
* বৃদ্ধ বাবাকে কেন্দ্র করে কোনো সন্তানের পরিবারে দাম্পত্য কলহ যাতে না হয় সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।
* তিনি কোনো কাজ করেন না, এ ধরনের কোনো কথা বলা বা ইঙ্গিত করা যাবে না।
* যদিও তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন, তারপরও তাঁর আশীর্বাদের আলো কিন্তু সব সময় সন্তানের ওপর থাকে। এটি সন্তানেরা যেন কখনো ভুলে না যায়।
* আপনি নিজে কর্মজীবী হলে সকালে বাবাকে নিয়ে হাঁটতে যেতে পারেন। বাবার সঙ্গে গল্প করার একটা সুযোগও পেয়ে যাবেন।
* তাঁর কী পছন্দ, কী করলে মন ভালো থাকে। সেটি করতে হবে। তাঁর মনের খবর জানতে চেষ্টা করতে হবে।
লেখক: মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
[email protected]