
অল্প কয়েক দিনের পরিচয়ে বন্ধু হওয়া যায় নাকি? দীর্ঘদিন ধরে যে আমার সুখে-দুঃখে পাশে ছিল, সে-ই কী প্রকৃত বন্ধু? জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় কারও কারও। কোনো একটা ঘটনায় অল্প দিনের চেনা সেই মানুষই হয়ে যেতে পারে সারা জীবনের বন্ধু।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, বন্ধুত্ব আটপৌরে। বন্ধুত্বের আটপৌরে কাপড়ের দুই-এক জায়গায় ছেঁড়া থাকিলেও চলে, ঈষৎ ময়লা হইলেও হানি নাই, হাঁটুর নীচে না পৌঁছিলেও পরিতে বারণ নাই। গায়ে দিয়া আরাম পাইলেই হইল। বন্ধুত্ব সম্পর্কটিই তো তাই। স্থান, কাল, বয়স, লিঙ্গ—কোনো কিছু সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।
নেহাত বন্ধুত্বের জন্য বন্ধুত্ব যেমন হয়, আবার প্রয়োজনেও হয়। সেই প্রয়োজন শুধু আর্থিক বা বৈষয়িক হবে এমন কোনো কথা নেই। চিন্তা-চেতনা, রুচির মিল থেকেও পেতে পারেন বন্ধু। সমমনা দুজন মানুষের একটি জগৎ থেকেই শুরু হয় বন্ধুত্ব। যেমন লেখা, গান, সাহিত্য-সংস্কৃতিপ্রেম থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের একটা দারুণ বন্ধুত্ব হয়েছিল। যদিও সেই বন্ধুত্ব পরে নষ্ট হয়ে যায়। এটাও বাস্তব।
কাজের সূত্রে পরিচয় হয়েছিল পারমিতা ও হিমেলের (ছদ্মনাম)। পরস্পরের আগ্রহের জায়গায় মিল থাকায় একধরনের বোঝাপড়া তৈরি হয়। যে মানুষকে হিমেল ভালোবাসে, তাকে কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না। পারমিতা বিষয়টি জানতে পারে। বন্ধুর জন্য সেই মেয়েটির সঙ্গে দেখা করে, তাকে বোঝানোর দায়িত্ব নেয়। অনেক চেষ্টার পরে সফলও হয়। হিমেল বলে, ‘পারমিতার সঙ্গে আমার খুব বেশি দিনের পরিচয় ছিল না। তিন-চার মাস হবে। সেভাবে “বন্ধু”ও বলা যায় না, পেশাদারি সম্পর্ক। খুব মন খারাপ ছিল আমার। কী হয়েছে জানতে চাওয়ায় ওকে বলেছিলাম আমার সমস্যার কথা। নিজে থেকে বলল আমাকে সাহায্য করতে পারে। সত্য বলতে কী, শুরুতে ওকে ঠিক অত বিশ্বাসও করতে পারিনি। কেন আগ বাড়িয়ে উপকার করতে চাইছে? সেটাও ভেবেছি। পারমিতার কারণে আমি ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করতে পেরেছি। ও আমাদের দুজনেরই ভালো বন্ধু হয়ে গেছে। এই দায়িত্ব কিন্তু আমার দীর্ঘদিনের চেনা বন্ধুরা নেয়নি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এহসান হাবীব মনে করেন, ভালো বন্ধু পরিবার, সমাজ, চারপাশের মনোসামাজিক উন্নয়নের জন্য দরকার। ছেলেমেয়ের বন্ধুত্ব মানেই প্রেম, অসম বয়স হলে চোখ কপালে তোলা—এগুলো করা উচিত না। ভালো রেস্তোরাঁয় খাওয়ালে, ভালো উপহার দিলেই ভালো বন্ধু হওয়া যায় না—সেটাও বুঝতে হবে।
বন্ধুদের এক আড্ডায় চেনা একজন তার আরেক বন্ধুকে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করেছিল। প্রশ্নটা ছিল, তোমার কাছের বন্ধুরা কি দীর্ঘদিনের বন্ধু? প্রশ্নকর্তার উত্তরে এক চোট হেসেছিল সেই বন্ধু। উত্তরে বলেছিল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাছের বন্ধু, বিশ্বস্ত বন্ধু তৈরি হয়। দীর্ঘদিনের অনেক কাছের বন্ধুও অনেক কথা জানতে পারে না। বিষয়টি ইচ্ছা করে ঘটে না। সব ঘটনা, পরিস্থিতিতে সবাইকে কাছে পাওয়া যায় না। নির্দিষ্ট ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যে বন্ধুত্ব হয়, দেখা গেছে তাদের মধ্যে এক-দুজন হয়েছে খুব কাছের বন্ধু। প্রকৃত বন্ধু, আসল বন্ধু বা কাছের বন্ধু যা-ই হোক না কেন, একমুহূর্তের পরিস্থিতি থেকেও হতে পারে।
এটি ঠিক যে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের মধ্যে আস্থা, বিশ্বাস, নির্ভরতা বেশি থাকে। তাই বলে নতুন বন্ধু হতে হলে তাকেও দশ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে—বন্ধুত্বের দাবির জন্য, তা-ও ঠিক নয়। জীবনের খুব খারাপ সময়ে, হতাশার মুহূর্তে আপনার থেকে বয়সে বড় কোনো একটি মানুষকে নিজের গোপন কষ্টের কথাটি জানালেন। তাঁর সঙ্গে নিশ্চয় আপনার শৈশব থেকে বেড়ে ওঠা হয়নি। তিনি হয়তো আপনাকে সেই আস্থা দিতে পেরেছিলেন। তিনি নারী নাকি পুরুষ, ছোট নাকি বড়, সেটা মুখ্য হয়ে ওঠে না। আপনার আবেগ, সমস্যা কিংবা আনন্দ-অনুভূতি উপলব্ধি করতে পারেন, আপনাকে অনুভব করেন—তিনিও তো আপনার কাছেরই বন্ধু। আপনার গোপন কথাটি অন্য কাউকে না জানিয়ে বিশ্বস্ততার পরিচয় দিলেন। এমন অনেক বন্ধু থাকে জীবনে, যারা নীরবে উপকার করে যায়, কথা দিয়ে, কাজ দিয়ে কখনো বলে বেড়ায় না কতটা উপকার করেছে আপনার। সেই বন্ধুটি অল্প দিনের চেনা হলেও কাছের বন্ধু হয়ে গেছে—সেটি কিন্তু আপনাকে বুঝে নিতে হবে।