বন্ধুর বিয়ে

.
.

পড়াশোনা প্রায় শেষ। কাছের বন্ধুবান্ধব কেউ কেউ চাকরিতে ঢুকছে। কেউবা আমার মতো এখনো লাইব্রেরির চার দেয়ালে স্বপ্ন আঁকছে। তো সেদিন লাইব্রেরিতে পড়ছি, এমন সময় আমানের ফোন এল। আমান আমার কলেজের বন্ধু। কাছাকাছি থাকি বলে খোঁজখবর প্রায়ই নেওয়া হয়। ভাবলাম ও বোধ হয় আমার ক্যাম্পাসে এসেছে। ফোন ধরতেই বলল, ‘আরমান কি ফোন করেছিল?’ আমি বললাম, ‘না তো! কেন কী হয়েছে?’ তারপর আমান জানাল আমাদের আরেক বন্ধু গালিফের বিয়ে। আরমানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কলেজের বন্ধুদের জানানোর।
গালিফের সঙ্গে আমার পরিচয় সেই ঢাকা কলেজের আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসের ১০৩ নম্বর রুমে। আমার বাড়ি কক্সবাজার আর ওর নীলফামারী। বাড়ির দূরত্ব অনেক হলেও মনের দূরত্বটা ছিল খুব কম। প্রথম ঢাকা এসে এই গালিফ, আমান, আরমান, শাওন—এরাই যেন আমার পরিবার হয়েছিল। হঠাৎ এমন একটা বন্ধুর বিয়ের খবর শুনে কেমন একটা যেন অনুভূতি হতে লাগল। আমাদের কারও যে বিয়ে হতে পারে, এ যেন এত দিন কল্পনার বাইরে ছিল। যা হোক, এর মধ্যে আরমান ফোন দিয়ে নিশ্চিত করল গালিফের বিয়ের খবর। গালিফও কেমন একটা লাজুকভাবে তার বিয়ের পাকা খবর এবং দিন-তারিখ জানাল। পাত্রী আমাদের আগে থেকেই পরিচিত; সেই কলেজের সময় থেকেই দুজনের প্রেম।
এত কাছের বন্ধুর বিয়েতে কী উপহার দিতে হয়, সে অভিজ্ঞতা আমার নেই। একটা গ্রামোফোন দিলে কেমন হয়, কিংবা রবীন্দ্রসমগ্র! বেকার জীবনে এত টাকাও পাওয়া মুশকিল। এসব ভাবতে ভাবতে খেয়াল হলো, আরমান, আমান, শাওন, ইমরান এদের সঙ্গে পরামর্শ করলেই তো হয়। সবাই মিলে ভালো কিছু দেওয়া যাবে। আরমানকে ফোন করতেই সে জানাল, উপহারের চিন্তা সে করে রেখেছে, আমাদের কোনো চিন্তা করতে হবে না। এসব ঘরোয়া কাজে আরমানের ওপর আস্থা রাখা যায়। হলে আমাদের যাবতীয় সমস্যার সমাধান সে অনায়াসে করে দিত।
অনলাইনে টিকিট কেটে রেখেছে আরমান। আমি, শাওন, আমান, আরমান যাব একসঙ্গে আর অন্যরা নিজেদের মতো করে যাবে। কাউন্টারে জমায়েত হতেই সেই পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণা শুরু হয়ে গেল। হাত ধরে রাখলে যে আমানের মুখ দিয়ে কথা বের হয় না, আরমানের সেই প্রেমিকার কথা, শাওনের অট্টহাসিতে বড় ভাইদের রুমে চলে আসা—এসব কথার ফাঁকে গালিফের জন্য সবার হাহাকার বেজে উঠল। তারপর কত পরিকল্পনা, কত আশা-ভরসার কথা বলতে বলতে সকালে চলে এলাম নীলফামারী। গালিফ সেখানেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। গালিফের সঙ্গে দেখা হতেই জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানালাম সবাই।
আপনারা এতক্ষণ যা ভাবলেন আমরাও তাই ভেবেছিলাম। না, আমরা ভুল ভেবেছি। বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে গালিফ জানাল, আসলে তার বিয়ে না। আমরা যেহেতু গালিফের বাড়ি অনেকবার যাব যাব করেও যায়নি, তাই আরমান আর গালিফ মিলে পরিকল্পনা করে আমাদের নিয়ে এসেছে উত্তরবঙ্গ বেড়াতে।
আমরা রাগ করব না কী করব, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না যেন। এভাবে নিজের বিয়ে নিয়ে মানুষ মজা করতে পারে, আমি প্রথম জানলাম। আমরা কেউ পরীক্ষা বাদ দিয়ে, কেউ টিউশনি, কেউ ক্লাস বাদ দিয়ে এসেছি বন্ধুর বিয়েতে অংশগ্রহণ করব বলে, আর বর কিনা বলে তার বিয়ে না!
প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে রেস্ট নেওয়ার পর শুরু হলো আমাদের আসল ভ্রমণ। সেবার পুরো উত্তরবঙ্গ ঘুরে বেড়িয়েছি আমরা। পুরোনো বন্ধুরা অনেক দিন পর একসঙ্গে হওয়ায় যাত্রা, সার্কাস, করিডর, ছিটমহল কিছুই যেন বাদ রাখিনি। কিছু ঘটনা সারা জীবন মনের মাঝে থেকে যায়। কিছু বন্ধুত্বও বুঝি কখনো শেষ হওয়ার নয়। গালিফের সত্যিকারের বিয়েতে যাওয়ার কথা দিয়ে আমরা এবারের মতো বিদায় নিলাম।
নিদেল শরিফ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।