বাসা থেকে বের হতেই হাবু আর নান্টুর সঙ্গে দেখা। আমি ধাই ধাই করে হাঁটা দিয়েছি সুজাপুর গ্রামের দিকে।
ওরা দুজন আমাকে দেখে জানতে চায়, ‘আংকেল, যান কোথায় সাতসকালে?’
আমি উল্টো জিজ্ঞেস করি, ‘তোরা এখানে? স্কুল-টিস্কুল নাই নাকি?’
‘আংকেল। স্কুল-টিস্কুল নাই। বন্যায় ডুইবা গেছে। আশা করি বন্যা আরও কিছুদিন থাকব। কী মজা!’
মফস্বলের এই দুই ছেলে মহা ত্যাঁদড়। সারা দিন একসঙ্গে থাকে। নানা দুষ্টুমিতে ওস্তাদ। দুষ্টুমি করলেও এলাকায় সবাই ওদের ভালোবাসে।
‘আংকেল, বললেন না তো কোথায় যাবেন?’
‘বিয়া খাইতে।’
‘কন কী! এই বন্যার মধ্যে বিয়া?’
‘আর বলিস না। তা-ও আবার বাল্যবিবাহ।’
‘বলেন কী! বাল্যবিয়া তো খাওয়াও অন্যায়। বদহজম হয়। আমাদেরও নিয়া চলেন।’
আমি বলি, ‘এই না বললি বদহজম হয়?’
‘বদহজম হবে না। আমাদের নিয়া চলেন।’
আমরা তিনজন হাঁটতে হাঁটতে মোড়ের রাস্তায় আসি। রিকশাওয়ালাকে বলি, ‘অ্যাই ভাই যাবেন?’
সে আয়েশ করে বসে ছিল রিকশায়। বলল, ‘সাঁতরাইয়া যান।’
লাল্টু বলল, ‘এইডা কী কইলেন চাচা মিয়া! সাঁতরাইয়া যামু মানে?’
রিকশাওয়ালা বলে, ‘জে। সড়কে গলাপানি।’
আমরা হাঁটতে হাঁটতে সড়কের দিকে যাই। সত্যিই দেখি বন্যার পানি থই থই করছে। কেউ নৌকায়। কেউ ভেলায়। কেউ লুঙ্গি উঁচু করে রাস্তা পার হচ্ছে। কী আজব দৃশ্য!
আমরা একটা কলার ভেলা পেলাম। সড়ক পার করে দিতে দেড় শ টাকা চাইল।
হাবু আর লাল্টু মহা উৎসাহী। তারা জীবনে কলাগাছের ভেলায় ওঠেনি।
আমরা তিনজন ভেলায় উঠে বসলাম। কিন্তু সেটায় ওঠার পরই পানিতে দুলতে লাগল। মাঝপথে গিয়েই ভেলা গেল উল্টে। আমরা তিনজন পানিতে পড়ে হাবুডুবু খেলাম।
সাঁতরিয়ে পাড়ে উঠলাম। হাবু বলল, ‘অ্যাই ভেজা কাপড়ে বিয়ে খেতে যাব?’ আমি বললাম, ‘কড়া রোদ উঠেছে। চল, হাঁটতে হাঁটতে কাপড় শুকিয়ে যাবে।’
আধা ঘণ্টা পরই আমরা সুজাপুর গ্রামে পৌঁছে যাই। আশপাশের গ্রামে পানি উঠলেও সুজাপুরে পানি ওঠেনি।
আমি এলাকায় মাতবর কিসিমের মানুষ। এদিক-সেদিক আমারে দুই-চারজনে চেনে। আমাকে দেখেই মেয়ের মামা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমি হাবু আর লাল্টুকে পরিচয় করিয়ে দিলাম, ‘আমার দুই ভাগনে।’ আমাদের তিনজনকেই নাশতা-পানি খেতে দেওয়া হলো। ওই সময় বরযাত্রী চলে এল। বাড়ির লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ল সেদিকে।
কিছুক্ষণ পর লাল্টু এসে বলল, ‘আংকেল। মাফ করে দিয়েন। বরের জুতা বন্যার পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে এলাম।’
‘কেন, কেন?’ যদিও আমি মনে মনে ওর কথা শুনে খুশি হয়েছি।
লাল্টু বলল, ‘আংকেল, আপনার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। একটু এদিকে আসেন।’ আমি লাল্টুর পেছন পেছন গেলাম। আমার পেছনে হাবুও আছে। লাল্টু ফিসফিস করে বলল, ‘আংকেল, মেয়ে তো আমাদের পরিচিত। ক্লাস এইটে পড়ে। আমাদের ক্লাসেই।’
‘বলিস কি রে?’
লাল্টু বলে, ‘আমি মেয়ের পাশে গিয়ে বসেছিলাম। আমাকে দেখে ফ্যা করে কেঁদে দিল। বলল, “আমারে বাঁচা।” এ কথা বলে বন্যার সে কী কান্না! ওর নাম বন্যা আহমেদ।’
হঠাৎ করে ঘাটে একটা নৌকা ভিড়ল। নৌকায় নানা রকম জিনিসপত্র।
আমি এগিয়ে যাই সেদিকে।
‘আপনারা কোথা থেকে আসিয়াছেন? কোথায় যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করিতেছেন?’ আমার প্রশ্ন শুনে নৌকার ঝাঁকড়া চুলের একটি ছেলে বলল, ‘আমরা ঢাবি থেকে আসছি, বন্যার্তদের ত্রাণ দিতে।’ ভূরুঙ্গামারী কোন দিকে বলতে পারেন?’
‘পারব না কেন। কিন্তু ঢাবিটা কী? বুঝিতে পারিলাম না।’
অন্য একটি ছেলে উত্তর দেয়, ‘আমরা ঢাকা থেকে এসেছি। ঢাবি মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।’
আমি বলি, ‘মারহাবা। মারহাবা। বাবাজিদের খাওয়াদাওয়া কিছু হইয়াছে?’
‘না, না। আমাদের খেতে হবে না। আংকেল আমাদের সঙ্গে যদি দু-একজন স্থানীয় লোকজন দিতেন, তাহলে আমাদের ত্রাণ বিতরণ করতে সহজ হতো।’
‘অবশ্যই। অবশ্যই। আগে খাওয়াদাওয়া হোক।’
এখনো বিয়ে পড়ানো হয়নি। আমি মেয়ের বাবাকে গিয়ে বলি, ‘ভাইসাব। ঢাকা থেকে কজন মেহমান আসছে। খাওন দিতে হয়?’
‘কন কী, কোনো অসুবিধা নাই। তাদের নিয়া আসেন।’ ঢাকার ছেলেদের খাবার খেতে বসিয়ে দিই। তারপর আমি যাই বরের কাছে। তার পাশে বসে কানে কানে বলি, ‘কিছুক্ষণের মধ্যেই থানা থেকে পুলিশ এসে পড়বে।’
বর বলে, ‘ক্যান?’
‘ক্যান মানে বুঝো না। তুমি তো বাবাজি বাল্যবিবাহ করতে আসছ। তোমারে তো জেলে ঢুকাইয়া দেবে।’
‘এখন উপায়?’
‘উপায় একটা আছে। তুমি পারবা?’
‘জে, পারব।’
‘ঢাকা থেকে ছেলেমেয়ে আসছে বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ দিতে। তুমি চুপি চুপি কলাবাগানের ভিতর দিয়া তাদের নৌকায় গিয়া উঠবা। কেউ যদি কিছু জিজ্ঞেস করে, বলবা, “বাথরুম পাইছে। বাথরুম থিকা আইতেছি”।’
‘ঠিক আছে চাচা, যাইতেছি।’
এদিকে লাল্টু ও হাবু এসে ফিসফিস করে বলে, ‘আংকেল, নৌকা পাওয়া যাইতেছে না। বন্যারে কেমনে নিয়া যাব?’
‘কাজ কর। কলার ভেলার মধ্যে ওরে উঠা। ও রাজি তো?’ হাবু বলে, ‘কন কী? ও পালানোর জন্য এক পায়ে খাড়া। আমাদের প্ল্যান শুনে আর কান্নাকাটি করছে না।’
‘যা তাড়াতাড়ি যা। কলার ভেলায় তুলে সোজা উলিপুরের দিকে রওনা দিবি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা খেয়েদেয়ে নৌকায় উঠেছে। চুপি চুপি সেই নৌকায় পাগড়ি পরে বরও উঠেছে। ইঞ্জিনচালিত নৌকা, হঠাৎ ভটভট শব্দ করে চলতে শুরু করে। আমিও সেই নৌকায় উঠেছি।
এদিকে উলিপুরের দিকে বন্যাকে নিয়ে ভেলায় ভেসে যাচ্ছে হাবু আর লাল্টু।
বরের দিকে তাকিয়ে আমরা মিটিমিটি হাসছি। বর অপ্রস্তুত হয়ে যাচ্ছে।
আমি বরের ঘাড়ে হাত দিয়ে বলি, ‘বাবাজি, চিন্তা করবে না। তোমার বিয়া আমি দিয়া দিব, ঐশ্বরিয়ার মতো সুন্দর একটা মেয়ে দেইখা।’ হঠাৎ একজন মহিলার চিৎকার। ‘হায়, হায় আমার বন্যারে পাইতেছি না। হইচই কোলাহল শুরু হয়ে গেল ওই বাড়িতে। বরপক্ষের কয়েকজন চিৎকার করছে, ‘বরকেও তো পাওয়া যাচ্ছে না।’
আমরা সামান্য দূরে চলে আসছি। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে বিয়েবাড়ি। কলাগাছের গেট। গেটে লেখা, ‘বন্যার শুভ বিবাহ’।
আমরা আধা ঘণ্টা পরই বন্যাদুর্গত এলাকায় পৌঁছে গেলাম। ঢাকার ছেলেরা ত্রাণের প্যাকেট তুলে দিচ্ছে বন্যার্তদের হাতে।
বর বসে আছে পাগড়ি মাথায়। আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসি। বলি, ‘বাবাজি, এখন কি পাগড়ি মাথায় দিয়া বইসা থাকার সময়। পাগড়ি খোলো। ওদের সঙ্গে কাজে হাত লাগাও।’