বন্য প্রাণীদের সেবায় তানিয়া খান

একটি আহত ভুবনচিলকে সেবা দিচ্ছেন তানিয়া খান l ছবি: সংগৃহীত
একটি আহত ভুবনচিলকে সেবা দিচ্ছেন তানিয়া খান l ছবি: সংগৃহীত

অচেনা বন্য প্রাণীর ছানাগুলো একদিন হয়তো মারাই যেত। আদর-যত্নে কোলে আশ্রয় দিয়ে কে আর তাদের লালনপালন করত। ছানাগুলোর খাবারদাবার, বেঁচে থাকার পরিবেশ সম্পর্কে কারই বা ধারণা আছে? সময় আছে? কিন্তু সন্তানের মতো কোলে তুলে খাওয়ানো, আদর দিয়ে ঘুমপাড়ানো কজনই বা করেন! প্রায় দেড় মাস পরম মমতা দিয়ে চারটি গন্ধগোকুলের ছানাকে আগলে রেখেছিলেন তানিয়া খান। বুনো পরিবেশে ফিরে যাওয়ার মতো অবস্থা হলে তাদের পাঠানো হয় বনে।

মৌলভীবাজারের বর্ষিজুরা ইকোপার্কের কাছে গত ৬ জুন সোনাপুর এলাকার একটি বাড়িতে গন্ধগোকুলের ছানাগুলো ধরা পড়ে। একই এলাকায় (সোনাপুর) নিজের বাসায় তানিয়া খান নিয়ে আসেন চারটি ছানা। নিজের হাতে খাঁচা বানিয়ে তাতে ডালপালা দিয়ে তৈরি করেন বন্য পরিবেশ। নিজেদের মতো শিকার ধরার কলাকৌশল কিছুটা আয়ত্তে আসার পরই ২০ জুলাই ছানাগুলো বন বিভাগের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের কাছে হস্তান্তর করেন তিনি। শুধু এই গন্ধগোকুলের ছানাই নয়, অনেক প্রাণীই তাঁর সেবা পেয়ে বনের কোলে ফিরে যেতে পেরেছে।

তানিয়া খানের (৪৫) এখন দিন কাটে হয় উদ্ধার হওয়া আহত বন্য প্রাণীর সেবা-শুশ্রূষা করে, নয়তো নতুন কোনো বন্য প্রাণীর খোঁজে বনবাদাড় চষে। নতুন কোনো প্রাণীর সন্ধান পেলে যেন তাঁর মুঠোয় ঝলমল করে আকাশের চাঁদ। এর বাইরে তাঁর আর কোনো জগৎই নেই। করেছেন ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা। হয়েছেন বন্য প্রাণী গবেষক, সংরক্ষক। নতুন নতুন প্রাণীর সন্ধানকারী।

২০০৬ সাল থেকেই বন্য প্রাণীর ছবি তুলতেন। ২০০৯ সালে বন বিভাগের রেঞ্জার মুনীর আহমেদ খানের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। ছোটবেলা থেকে তানিয়ার মধ্যে যে প্রাণীপ্রেম ছিল, তা যেন নতুন মাত্রা পেল। কখনো মুনীর আহমেদ খানের সঙ্গে, কখনো একা, কখনো অন্যদের সঙ্গে দল বেঁধে ছুটে গেছেন এ বন থেকে ও বনে। বার্ড ক্লাবের সদস্য হয়ে প্রাণিকুল রক্ষায় সময়-শ্রম দিয়ে চলেছেন। কাজ করেছেন আইইউসিএন (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব কনজারভেশন ফর ন্যাচার), নিসর্গসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে। শকুন সংরক্ষণ, বন্য প্রাণীর সংখ্যা, অবস্থা ও অবস্থান নিয়ে তথ্য সংগ্রহমূলক কার্যক্রমেও জড়িত ছিলেন তানিয়া। ‘আগে বন্য প্রাণীর যেকোনো তথ্যের জন্য বিদেশের ওপর নির্ভর করতে হতো। ২০১২ সালের পর থেকে দেশেই বন্য প্রাণীর তথ্যভান্ডার তৈরি হচ্ছে।’ বললেন তানিয়া খান।

২০১৪ সালে হবিগঞ্জের সাতছড়ি সংরক্ষিত বনাঞ্চলে খুঁজে পান থ্রি স্টামস বাংকিং নামের একটি পাখি। এই পাখি দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় এবং দেশে প্রথম দেখার রেকর্ড হয়। ২০১৩ সালে সাতছড়িতে হিল ব্লু ফ্লাই ক্যাচার খুঁজে পান। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ‘পাইড ওয়ার্টি ফ্রগ’ নামের একটি ক্ষুদ্র ব্যাঙ আবিষ্কার করেন ২০১২ সালে। এ ছাড়া ‘বুশ ফ্রগ’ জাতের আরও একটি ব্যাঙের দেখাও পেয়েছেন, যার নাম এখনো নিশ্চিত করা হয়নি। ২০১২ সালে প্রথম এবং ২০১৬ সালে দ্বিতীয়বার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে মৃত ‘চিকিলা ফুলেরি’ নামের একটি প্রাণী আবিষ্কার করেন তানিয়া খান। এটি একটি অতি বিরল প্রাণী। মৌলভীবাজারের আদমপুরে ‘ফলস কোবরা’ নামের একটি সাপ এবং লাউয়াছড়ায় ‘হিমালয়ান মোল’ নামের এক প্রাণী আবিষ্কার করেন। এ দুটি প্রাণীও দেশে প্রথম দেখার রেকর্ড তানিয়ারই। এ পর্যন্ত যৌথভাবে প্রজাপতি, বামন মাছরাঙা নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তাঁর চারটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

তানিয়া খানের সেবা-শুশ্রূষা পেয়ে প্রাণীই সুস্থ হয়েছে। বনে ফিরে ‘বন্যেরা বনে সুন্দর’ পঙ্‌ক্তিটিকে সার্থক করেছে। এই প্রাণীগুলোর মধ্যে আছে বিরল প্রজাতির একটি কালো শকুন। প্রায় সাড়ে তিন মাস শকুনটিকে শুশ্রূষা দিয়ে সুস্থ করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তানিয়া বলেন, এরা বিভিন্নজনের হাতে ধরা পড়ে। কারও আক্রমণে আহত হয়। এদের উদ্ধার করে এনে চিকিৎসা ও সেবা-যত্ন করে পুরো সুস্থ হলে তবেই ছেড়ে দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে উদ্ধার হলে চিকিৎসার পাশাপাশি যা বেশি দরকার তা হচ্ছে মাতৃস্নেহে পরিচর্যা করা।

তানিয়ার এই কাজে বরাবরই উৎসাহ জুগিয়েছেন প্রয়াত স্বামী মুনির আহমেদ খান। পাখি ও বন্য প্রাণী নিয়ে কাজ করেন এমন কিছু মানুষের কথাও বললেন তানিয়া। জানালেন ইনাম আল হক, নিয়াজ আহমদ, মনিরুল এইচ খান, রোনাল্ড হালদার, সায়েম ইউ চৌধুরী, সীমান্ত দীপু, সিজার শাহরিয়ার রহমান, মো. ফয়সল, মো. লাভলু প্রমুখ সব সময় তাঁকে উৎসাহ দেন। তানিয়ার সঙ্গে সব সময় থাকে কিশোর মো. রফিক মিয়া। তানিয়া খান বলেন, ‘শুধু বন্য প্রাণী নয়, সব ধরনের প্রাণীর সঙ্গে আমার জীবন মিলেমিশে গেছে। বন্য প্রাণীর বাইরে আর ভাবার কিছু নেই। ঘরে যদি আহত প্রাণী না থাকে, তখন বনে চলে যাই। নতুন প্রাণী খুঁজি। কোন মৌসুমে কোন প্রাণী কোথায় থাকে, কী করে, কোন গাছে থাকে, তা দেখি। এসব তথ্য জানা খুব দরকার।’ বিপন্ন প্রাণী নিয়ে কাজ করার জন্য সোল (সেভ আওয়ার আনপ্রটেক্টেড লাইফ) নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন তিনি।

তানিয়া খান বলেন, মানুষসহ সমগ্র প্রাণিকুলই এখন বিপদের মুখে। শকুন নির্বংশ হচ্ছে। যক্ষ্মা হচ্ছে মানুষের। প্রাণী ধ্বংসের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ।

বন বিভাগের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মিহির কুমার দে বলেন, ‘তানিয়া খান অনেক দিন ধরে সাতছড়ি ও লাউয়াছড়ায় বন্য প্রাণী নিয়ে কাজ করছেন। প্রজাপতি নিয়ে বর্ষিজুরা ইকোপার্কে কাজ করতে আমি দেখেছি। বন্য প্রাণীর প্রতি তাঁর অনেক ভালোবাসা। এটা ভালো একটা কাজ।’ এই ভালো কাজেই সুস্থ হচ্ছে অনেক বন্য প্রাণী।