বলাও যায় না, সহ্যও করা যায় না

আধখানা ঘোমটায় ঢাকা নতুন বউ। তার পাশে বসে নিচু গলায় গল্প করতে করতে বাড়ি ফিরছে জাফর। জীবনে এই প্রথম পাঁচ ঘণ্টার বাসযাত্রা তার কাছে মনে হচ্ছে মাত্র আধ ঘণ্টা। এতক্ষণ বউ ভালোই কথাবার্তা বলছিল, হঠাৎ কেমন যেন কাঁচুমাচু করতে শুরু করেছে।
জাফর জিজ্ঞেস করে, ‘খারাপ লাগছে?’ বউ কপট হাসিমুখে ‘না’ জানাল। এই ভ্যাপসা গরমে ফেরিঘাটের জ্যামে আটকে জীবন যখন অতিষ্ঠ ঠিক তখনই দেবদূতের মতো আবির্ভূত হলেন এক ডাবওয়ালা। তাঁর কাছ থেকে ডাব নিয়ে যত্ন করে স্ট্র লাগিয়ে বউকে দিতে দিতে বলল, ‘নাও, এইবার একটু শান্তি পাবে।’
কিন্তু বউ এমন যত্নশীল স্বামীর কথার তোয়াক্কা না করে ডাব হাতে উদাসমুখে বসে রইল। জাফরের মেজাজ এতটাই খারাপ হলো যে সে মুহূর্তের মধ্যে দুইটা ডাবের সবটুকু পানি ঢকঢক করে গিলে ফেলল। আর বউ চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগল কখন বাস থামবে। কখন সে বাড়ি যাবে।
গাঁয়ের লাজুক বধূ কিংবা চাকরিজীবী নারী যেই হোক, প্রস্রাব চেপে রাখার সব রকম কৌশল তারা প্রয়োগ করবেই করবে। তবুও পাশে থাকা কাছের বন্ধুটিকে কিংবা তাদের প্রিয়জনকে সহ্যের শেষ সীমা অতিক্রমের আগ অবধি কিচ্ছু বলতে পারে না। অথচ অনেকক্ষণ প্রস্রাব ধরে রাখলে সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। গঠনগত কারণে মেয়েদের প্রস্রাবসংক্রান্ত সংক্রমণ বেশি হয়। আর কম পানি পান করা তাদের বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত সমস্যার ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। বেশির ভাগ নারীই এই কথাটা বলতে সংকোচ বোধ করেন। অনেকে আবার নিরাপত্তার কথা ভেবেও পাবলিক টয়লেট এড়িয়ে চলেন। আর তার সঙ্গে নোংরা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তো রয়েছেই। আরও একটা ব্যাপার, তা হলো প্রয়োজনের সময়, বিশেষ করে কোথাও যাওয়ার সময় যদি পথে টয়লেট না পাওয়া যায় তাই কম পানি পান করেন।
বর্তমানে নারীদের বাইরের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বেড়েছে। বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া, বাজার করা থেকে শুরু করে প্রায় সব কাজের জন্য তাদের বাইরে যেতে হচ্ছে। কর্মজীবী নারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অথচ অনেকেই নিজের কর্মক্ষেত্রেও এই ন্যূনতম সুবিধাটুকুও পাচ্ছেন না। অনেক সরকারি অফিস এমনকি সরকারি হাসপাতালগুলোতেও নারী কর্মীরা মানসম্মত টয়লেটের সুবিধা পান না। অথচ সেখানেই তাঁদের ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা কাটাতে হচ্ছে! ব্যাপারটা আপনাদের কাছে খুব অদ্ভুত মনে হচ্ছে, তাই না? কিন্তু এটাই বাস্তবতা!
আমাদের জেলা শহরগুলোর কথা নাই বা বললাম, রাজধানী বা বিভাগীয় শহরেও পাবলিক টয়লেটের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। আর যা আছে সেখানকার পরিবেশ কেমন তা আশা করি আপনারা আন্দাজ করতে পারছেন। সিঙ্গাপুরে শুধু বাথরুম ব্যবস্থাপনার জন্য তাদের আলাদা একটা সরকারি সংস্থা রয়েছে, ভাবা যায়!
একটা জার্নালে পড়েছিলাম, ভ্রমণের সময় যদি বাথরুম চাপে শক্ত হয়ে বসে থেকো না, সুযোগ পেলেই নেমে যাও। কারণ এই ‘এক্সট্রা মাইলস’ ভ্রমণ করে তোমার ইউরিনারি ট্র্যাক্ট সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ানোর কোনো মানে হয় না। কিন্তু আমাদের বেলায় কী করব যেখানে বাথরুম খুঁজে পাওয়াটাই একটা বড়সড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়!
জীবনে এমন সমস্যার মুখোমুখি হয়নি এমন মেয়ে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সত্যি বলতে আমরা কম-বেশি সবাই এর সম্মুখীন হই ঠিকই, তবে মুখ ফুটে বলতে আমাদের রাজ্যের দ্বিধা আর সংকোচ। কিন্তু কেন? এটা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার নয় কি? এতে যেমন লজ্জায় নীল হওয়ার কোনো কারণ নেই, তেমনি মেয়েদের পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করতে দেখলে বা বাস থামিয়ে বাথরুমে যাচ্ছে বলে বাঁকা চোখে দেখারও অবকাশ নেই।
লেখক: চিকিৎসক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়