বাঁশি ভালোবাসি

অন্য ভুবন: তাঁরা আমাদের খুবই পরিচিত। যেভাবে আমরা তাঁদের চিনি, এর বাইরেও রয়েছে তাঁদের ভিন্ন জগৎ। আসুন, সেই জগতে ঘুরে এই চেনা মানুষগুলোকেই এবার দেখি একটু অন্য আলোয়

জুয়েল আইচ, জাদুশিল্পী
জুয়েল আইচ, জাদুশিল্পী

কে বাঁশি বাজায় রে...
আমার শৈশব কেটেছে বরিশালের স্বরূপকাঠি থানার সমুদয়কািঠ গ্রামে। বাড়ি থেকে প্রতি রাতেই শুনতে পেতাম একটা মিষ্টি বা‌ঁিশর সুর। অলৌকিকভাবে বাজতে থাকা সেই সুরটা মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমাকে টানত। একদিন জানলাম, নির্মল রায় নামে একজন আমাদের বাড়ির পাশে এই বাঁশি বাজান।
প্রতিবছরই মাসব্যাপী খুব জাঁকজমকভাবে বৈশাখী মেলা হতো গ্রামে। বাবার সঙ্গে একবার মেলায় গিয়ে খুব কাছেই শুনতে পেলাম পরিচিত সুর। জানলাম, সেই নির্মল রায় বাঁশি বাজাচ্ছেন এখানে। বাঁশির প্রতি ভালোবাসার শুরু এভাবেই।

নিতাই কৈবর্তের সেই বাঁশি
আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালের অপর পারেই থাকত কিছু কৈবর্ত পরিবার। সংগীত, যাত্রাপালা, কবিগানসহ নানা ধরনের সংস্কৃতির চর্চা ছিল তাদের মধ্যে। বাঁশির সুর শুনেছি সেখানেও। একদিন এই সুরের টানে ছুটে গিয়েছিলাম। প্রথম পরিচয়েই বাঁশির বাদক ছোট্ট নিতাই কৈবর্ত আমার হাতে তুলে দেয় তার শখের বাঁশিটি। সে-ই বাঁশির সুরে তুলতে শিখিয়েছিল সারেগামা। সেই থেকে আমার বাঁশি বাজানো শুরু। যখন ক্লাস সিক্সে উঠেছি, বাবা গ্রাম থেকে শহরে নিয়ে ভর্তি করিয়ে দিলেন বিখ্যাত পিরোজপুর গভর্নমেন্ট স্কুলে। গ্রামে বাঁশি বাজাতে কোনো বাধা ছিল না, তবে শহরে যাতে আমার বাঁশির সুর কারও বিরক্তির কারণ না হয় সে জন্য এর ভেতরে খানিকটা কাগজ ঢুকিয়ে নিতাম।

উপহার এক বয়াম চিনাবাদাম
শৈশবে একবার গ্রামের বাড়িতে বন্ধুরা মিলে একটা দোকানের সামনে আড্ডা দিচ্ছিলাম। গ্রাম ও শহরের সর্বত্রই তখন ছিল রূপবান যাত্রাপালার জয়জয়কার। দোকানদার বলল, যে সবচেয়ে সুন্দর করে রূপবানের সুর বাজাতে পারবে তাকে উপহার হিসেবে দেওয়া হবে এক বয়াম চিনাবাদাম। এবার বাজাতে শুরু করল একজন একজন করে। আমার পালা এলে বেশ খানিকটা ভয়ে ভয়েই বাজালাম। বাদন শেষ হতেই একসঙ্গে সবার চিৎকার, বলল, আমিই সবচেয়ে ভালো বাজিয়েছি! বাঁশি বাজিয়ে সেই প্রথম উপহার পেলাম এক বয়াম চিনাবাদাম। সেবারই বংশীবাদক পরিমল দাস বাঁশিশে সুর তোলার আরও কিছু কৌশল শেখালেন। এরপর নিজে থেকেই মান্না দে, লতা মঙ্গেশকর, শ্যামল মিত্রদের অতি জনপ্রিয় গানের সুরগুলো বাঁশিতে তুলতাম।

বাঁশিতে সুরই বেরোল না!
পিরোজপুরে কলেজে পড়ার সময়কার ঘটনা। তত দিনে আমার বাঁশি বাদনের কথা অনেকেই জানে। সবাই মিলে ধরল, কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাঁশি বাজাতে হবে। তো, কলেজের অনুষ্ঠানে মঞ্চে উঠে সামনের আসনে বসা মেয়েদের দেখে এতটাই নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম, বাঁশি দিয়ে আর সুরই বের হচ্ছিল না! এরপর প্রতিজ্ঞা করলাম, সামনের অনুষ্ঠানে যেভাবেই হোক ভালো করে বাঁশি বাজাতে হবে।
এই নিয়ে আছে একটি মজার ঘটনা। জড়তা কাটানোর জন্য কলেজের অতি উৎসাহী কয়েকজন বন্ধু রাতের অন্ধকারে আমাকে কলেজের মেয়েদের বাসার কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে বলল, ‘নে, এবার বাজা’। এ সময় তারা আমাকে পাহারা দিত আর চোখ বুজে আমি সুর তুলতাম বাঁশিতে। একদিন বাঁশি বাজাচ্ছি। এমন সময় লাঠি হাতে এক অভিভাবক তেড়ে এলেন, তাকিয়ে দেখি আশপাশে বন্ধুরা কেউ নেই। এর পর থেকে আর বাইরে নয়, বাড়িতে বসেই চর্চা করতাম।
পরের মাসেই কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমার বাঁশি শুনে মিলনায়তনজুড়ে নেমে এল পিনপতন নীরবতা। বাদন শেষ হওয়ামাত্র মঞ্চে গিয়ে বন্ধুরা ঘাড়ে তুলে নিল আমাকে। এরপর অনেক বড় বড় অনুষ্ঠান ছাড়াও ঢাকা রেডিও, আকাশ বাণী কলকাতা, বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকাসহ বিভিন্ন জায়গায় শ্রোতাদের বাঁশি শোনানোর সৌভাগ্য হয়েছে আমার।
অনুলিখন: বিপাশা রায়