বাংলাদেশের অর্জন ৭টি পদক

অনলাইনে আয়োজিত গ্লোবাল ই-কম্পিটিশন অন অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকসে (জিইসিএএ) বাংলাদেশ পেয়েছে সাতটি পদক। পদকজয়ীদের অভিজ্ঞতা জানতে তাদের সঙ্গে গুগল মিট-এ এক ভার্চ্যুয়াল মিটিংয়ে যুক্ত হয়েছিলেন আলিমুজ্জামান।

সব মিলিয়ে দুটি রৌপ্য, তিনটি ব্রোঞ্জ, একটি সম্মাননা ও একটি সেরা দলীয় পদক নিয়ে এ বছর বাংলাদেশ দলের অর্জন কম নয়

পৃথিবীর একেক দেশে একেকজন প্রতিযোগী। কারও আকাশ পরিষ্কার, কেউ বা মেঘের কারণে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কারও কারও আবার সময়ের ব্যবধান দিন-রাত। তবে সবাই মিলে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে একটা প্রশ্নের উত্তর—পৃথিবী থেকে চাঁদ কত দূরে?

বহু বছর আগে জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিপাক্রাস চন্দ্রগ্রহণকে কাজে লাগিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করেন। ২০২০ সালে দাঁড়িয়ে একই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টাসহ জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান নিয়ে নানা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছিল একদল কিশোর-তরুণ। অনলাইনে ‘গ্লোবাল ই-কম্পিটিশন অন অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকস (জিইসিএএ) ’ আয়োজনে এক হয়েছিল তারা।

করোনার প্রকোপে এ বছর বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিয়াড অন অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকস (আইওএএ)। তবে অনলাইনে যেন জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চা চালিয়ে যাওয়া যায়, সেই লক্ষ্যে এ বছর প্রথমবারের মতো আয়োজিত হলো জিইসিএএ। আয়োজনটি পরিচালিত হয় ইউরোপের দেশ এস্তোনিয়া থেকে। ৪০টির বেশি দেশের প্রায় সাড়ে ৩০০ শিক্ষার্থী অংশ নেয় এই আয়োজনে। যাদের মধ্যে ছিল বাংলাদেশ দলও। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক এই আয়োজনের বাছাই পর্ব পরিচালনা করে বাংলাদেশ অলিম্পিয়াড অন অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স।

বাংলাদেশের অর্জন

দেশে কয়েক ধাপে বাছাইপ্রক্রিয়া পেরিয়ে জিইসিএএতে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিল ঢাকার নটর ডেম কলেজের আরমান হাসান, মো. জীম মীম সিদ্দিকী, আবদুল্লাহ আল রাফি, তূর্য রায়, মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের সিরাত মাহমুদ, শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজের আনাম বিন মোর্শেদ এবং ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাজিয়া শাহরিন। পুরস্কার এসেছে সবার ঝুলিতেই। সিরাত মাহমুদ ও আবদুল্লাহ আল রাফি পেয়েছে রৌপ্যপদক, আরমান হাসান, জীম মীম সিদ্দিকী ও সাজিয়া শাহরিন পেয়েছে ব্রোঞ্জপদক, তুর্য রায়ের অর্জন সম্মাননা পদক। আর দলের সর্বশেষ পদকটি আসে আনাম বিন মোর্শেদের কাছ থেকে। দলগত প্রতিযোগিতায় সেরা দলের সদস্য ছিল সে। সব মিলিয়ে দুটি রৌপ্য, তিনটি ব্রোঞ্জ, একটি সম্মাননা ও একটি সেরা দলীয় পদক নিয়ে এ বছর বাংলাদেশ দলের অর্জন কম নয়।

যেভাবে এই আয়োজন

জিইসিএএ শুরু হয় গত ২৫ সেপ্টেম্বর। মাসব্যাপী এই আয়োজনে অংশগ্রহণকারীরা ব্যক্তিগত ও দলগতভাবে অংশ নিতে পারে। কিন্তু দল তৈরি হয় বিভিন্ন দেশের অংশগ্রহণকারীদের সমন্বয়ে, যা ঠিক করে দেন আয়োজকেরা। প্রথম দিনেই শুরু হয় ব্যক্তিগত পর্যায়ের তত্ত্বীয় লিখিত পরীক্ষা। তিন ঘণ্টাব্যাপী এই পরীক্ষা চলাকালে অংশগ্রহণকারীদের জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কিত নানা তত্ত্বীয় বিষয়ের প্রশ্নোত্তর লিখে সেটির ছবি তুলে জমা দিতে হয়। পরদিন শুরু হয় তথ্য বিশ্লেষণ পর্ব। তিন ঘণ্টার এই পর্বে জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণা সম্পর্কিত যেকোনো তথ্য ব্যবহার করে সেটির মাধ্যমে নানা রকম সমস্যার সমাধান করতে হয়। আর সবশেষে থাকে ‘ভার্চ্যুয়াল অবজারভেশন’ পর্ব।। এই পর্বে অংশগ্রহণকারীদের কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে আকাশের বিভিন্ন অংশে তারাদের অবস্থান চিহ্নিত করতে হয়। তিন পর্ব মিলিয়ে শেষ হয় ব্যক্তিগত অংশের প্রতিযোগিতা।

সব দলের জন্য কাজ ছিল একটাই—পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব বের করতে হবে। গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান আর হাতের কাছে থাকা প্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্ণয় করতে হবে এই দূরত্বের মান। আয়োজনে অংশগ্রহণকারীদের অনুপ্রেরণা দিতে অনলাইনে যোগ দেন নভোচারী ক্যাথেরিন কোলম্যান। এ পর্বে সেরা দল নির্বাচিত হয় টিম রেটিকাম। আর এই দলের সদস্য ছিল বাংলাদেশের আনাম বিন মোর্শেদ।

জ্যোতির্বিজ্ঞান ও অন্যান্য

পুরো আয়োজন অনলাইনে হয়েছিল বলে উৎসব যে একেবারেই হয়নি, তা নয়। বিশ্বের নানা প্রান্তের খুদে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা একসঙ্গে গেম খেলা, চলচ্চিত্র দেখা, নিজেদের দেশের গান শোনা—সবই উপভোগ করেছেন।

বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে পুরোনো সদস্য আবদুল্লাহ আল রাফি মাহমুদ। গত বছর দলের জন্য কোনো পদক আনতে না পারলেও এবার নিজের প্রস্তুতির কোনো কমতি রাখেনি সে। স্নাতক পর্যায়েও জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনার আগ্রহের কথা বলল সে। অন্যদিকে দলের সবচেয়ে চুপচাপ সদস্য তূর্য রায়। এই দলে আসার আগে নিজের ওপর আস্থা ছিল কম। অলিম্পিয়াডের সুবাদে আস্থা বেড়েছে, এখন একটু একটু করে শিখছে সে।

এ বছরই প্রথম এমন আয়োজনে অংশ নিল জীম মীম সিদ্দিকী। বলছিল, ‘ভাবতে পারিনি আন্তর্জাতিক দলে সুযোগ পেয়ে যাব।’ বাছাইপর্বের ক্যাম্প চলার সময় ময়মনসিংহে গ্রামের বাড়িতে ছিল জীম। বাড়ি থেকে প্রতিদিন পাঁচ কিলোমিটার দূরে গিয়ে ইন্টারনেট–সংযোগের আওতায় এসে ক্লাসে যুক্ত হতো সে। এত পরিশ্রমের পর নিজের অর্জন নিয়ে তাই খুব খুশি জীম।

নানা সহশিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত আরেক সদস্য আরমান হাসান। শুরুতে সংশয় ছিল, পরে আত্মবিশ্বাস পেয়েছে সে। আরমান বলে, ‘অলিম্পিয়াডের সমস্যা সমাধান করতে ভালো লাগত। তাই লেগে থেকেছি।’ স্নাতকে দেশেই প্রকৌশল পড়তে চায় সে।

আগামী দিনের প্রত্যাশা জানতে চাইলে এককথায় উত্তর দেয় সাজিয়া শাহরিন, ‘আন্তর্জাতিক দলে আরও মেয়ে সদস্য দেখতে চাই।’ সাজিয়া বলে, ‘আন্তর্জাতিক যেসব অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ অংশ নেয়, সেগুলোর বেশির ভাগের দলে মেয়ে সদস্য নেই কিংবা কম। বিজ্ঞানচর্চায় যেন আরও অনেক মেয়ে অংশগ্রহণ করে, সেটাই আমার প্রত্যাশা।’ শাস্ত্রীয় আর মেটাল—দুই ধরনের গানই আছে সাজিয়ার পছন্দের তালিকায়। মনে মনে ড্রামার হতে চাইলেও জ্যোতির্বিজ্ঞানে স্নাতকের স্বপ্নটাও আছে তার।

ক্যাডেট কলেজের কঠোর শৃঙ্খলায় বড় হলেও সিরাত মাহমুদের ভাবনার জগতে কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। ভিন্নভাবে ভাবতে চেষ্টা করে সব সময়। স্নাতকে যুক্তরাষ্ট্রে আবেদনের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ততা আছে। তবু ভালোবাসা থেকে এই আয়োজনে সময় দিয়েছিল। অর্থনীতি আর ইতিহাসে কিছুটা ঝোঁক আছে তার। সে সব বিষয় নিয়ে পড়বে ভাবছে।

আনাম বিন মোরশেদ জানিয়ে দিল তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, ‘জ্যোতির্বিজ্ঞানে স্নাতক শেষ করে স্পেসএক্স কিংবা নাসায় কাজ করতে চাই।’ দলগতভাবে বিদেশি অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে আনাম বলে, ‘ওরা খুব সাহায্য করছে। প্রতিযোগিতা চলাকালীন আমার এখানে আকাশ পরিষ্কার ছিল না। তাই ওরা ছবি তুলে পাঠাত। যেটা দেখে আমরা হিসাব-নিকাশ করতাম। দলের সবার সঙ্গে মিলিয়ে প্রতিদিনের মিটিং হতো রাত আটটায়। তাই সারা দিনের কাজ গুছিয়ে ওদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের অপেক্ষায় থাকতাম।’ আনামদের অভিজ্ঞতাও নিশ্চয়ই আগামী দিনের অংশগ্রহণকারীদের কাজে আসবে।