বাংলাদেশের তাঁরা তিন বিজ্ঞানী

সিঙ্গাপুরভিত্তিক সাময়িকী এশিয়ান সায়েন্টিস্ট গত ২৬ এপ্রিল এশিয়ার শীর্ষ ১০০ বিজ্ঞানীর নাম প্রকাশ করেছে। ‘দ্য এশিয়ান সায়েন্টিস্ট ১০০’ শিরোনামে এই তালিকার ৬ষ্ঠ সংস্করণে স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশের তিন বিজ্ঞানী। তাঁরা হলেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) ইমিউনোলজি বিভাগের প্রধান ফেরদৌসী কাদরী, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস কৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামিয়া সাবরিনা এবং মডেল লাইভস্টক অ্যাডভান্সমেন্ট ফাউন্ডেশনের (এমএলএএফ) চেয়ারম্যান সালমা সুলতানা। তিন বিজ্ঞানী জানিয়েছেন তাঁদের কাজ নিয়ে স্বপ্নের কথা।

টিকায় স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশের স্বপ্ন দেখেন ফেরদৌসী কাদরী

বিজ্ঞানী ফেরদৌসী কাদরী

একদিন দেশেই সব রোগের টিকা তৈরি হবে এবং বাংলাদেশ হবে টিকায় স্বয়ংসম্পূর্ণ—এমন একটি স্বপ্ন নিয়ে কাজ করছেন বিজ্ঞানী ফেরদৌসী কাদরী। সারা বিশ্ব এখন কোভিড-১৯ যুদ্ধে লড়ছে। বাংলাদেশও এ লড়াইয়ে শামিল। ফেরদৌসী কাদরীর মনোযোগও এখন কোভিড-১৯-এ। তিনি জানান, এরই মধ্যে এ নিয়ে দুই ধরনের গবেষণা করছেন তিনি। গত বছর থেকে ১০০ জন কোভিডে আক্রান্ত রোগীর ওপর একটি গবেষণা পরিচালনা করছেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে কোভিড টিকাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নিয়ে দুই বছর মেয়াদে আরেকটি গবেষণা শুরু করেছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সঙ্গে। দুই ক্ষেত্রেই মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অ্যান্টিবডি পরীক্ষা।

ফেরদৌসী কাদরী বলেন, ১০০ জন কোভিড রোগীর অনেকের কোনো উপসর্গ ছিল না, অনেকের মৃদু উপসর্গ ছিল, কেউ কেউ গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। আর দুই বছর মেয়াদে ধাপে ধাপে সাত হাজারের মতো টিকাপ্রাপ্ত মানুষের ওপর গবেষণা চালানো হবে।

টিকা দেওয়ার পর কী ধরনের প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হয়, অসুস্থতার বিপরীতে শরীর কতটা সাড়া দেয়, টিকার প্রতিরোধক্ষমতা ও কার্যকারিতা কত দিন স্থায়ী হবে, সেটা পরীক্ষা করবেন ফেরদৌসী কাদরী। দেশে এখন কোভিডের নানা ধরন (ভেরিয়েন্ট) ঢুকে পড়েছে। এ ধরনগুলোর ওপরও গবেষণা করছেন। জানান, এখন দক্ষিণ আফ্রিকার ধরনটি সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে।

কলেরা মহামারি থেকে রক্ষার জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের টিকা নিয়ে দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে কাজ করছেন ফেরদৌস কাদরী। গত বছর পরীক্ষামূলকভাবে রাজধানীর ১২ লাখ মানুষের ওপর প্রথম ডোজের টিকা দেওয়ার পর করোনার কারণে কাজটি বাধাগ্রস্ত হয়।

ফেরদৌসী কাদরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণরসায়ন ও মলিকুলার বায়োলজি বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষে আইসিডিডিআরবিতে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৮৮ সালে। এর আগে ছয় বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। দেশ-বিদেশের ১১টি পুরস্কার ও ১৪টি সম্মাননা পেয়েছেন কাজের স্বীকৃতি হিসেবে। ২০২০ সালে তিনি বিল গেটস হিরোস ইন দ্য ফিল্ড এবং এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিজ্ঞানজয়ী নারীদের জন্য প্রবর্তিত লরিয়েল-ইউনেসকো আন্তর্জাতিক পুরস্কার পান।

দেশের টানে ফিরে এসেছিলেন সামিয়া সাবরিনা

অধ্যাপক সামিয়া সাবরিনা

ইলেকট্রনিকস পণ্যের ক্ষেত্রে এখন ‘স্লিম’ আকারের জয়জয়কার চলছে। মাইক্রো, ন্যানো...ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতরের দিকে প্রযুক্তি ছুটে চলেছে। মাইক্রোমিটারের চেয়ে এক হাজার গুণ ছোট ন্যানোমিটার। অর্থাৎ ন্যানোমিটার হচ্ছে ১০০ কোটির এক ভাগ (টেন টু দ্য পাওয়ার মাইনাস নাইন)। কত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র উপাদান দিয়ে শক্তিশালী যন্ত্র তৈরি করা যায়, সেই প্রতিযোগিতা চলছে। শিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি, ওষুধ, পরিবেশবিজ্ঞান, জ্বালানি, খাদ্যনিরাপত্তা ইত্যাদিতে চলছে ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার।

অধ্যাপক সামিয়া সাবরিনা এশিয়ার ১০০ বিজ্ঞানীর মধ্যে থাকার স্বীকৃতি পেয়েছেন এই ন্যানোম্যাটেরিয়াল নিয়ে তাঁর কাজের জন্য। ন্যানোম্যাটেরিয়ালের ব্যবহার নিয়ে গবেষণার জন্য গত বছর নারী বিজ্ঞানী হিসেবে ‘ওডব্লিউএসডি-এলসেভিয়ের ফাউন্ডেশন অ্যাওয়ার্ডস ফর আর্লি ক্যারিয়ার ওমেন সায়েন্টিস্ট ইন দ্য ডেভেলপিং ওয়ার্ল্ড’ পুরস্কার পান তিনি। এটি ইতালিভিত্তিক সংস্থা ‘অর্গানাইজেশন ফর উইমেন ইন সায়েন্স ফর দ্য ডেভেলপিং ওয়ার্ল্ড (ওডব্লিউএসডি)’ এবং নেদারল্যান্ডসভিত্তিক বিজ্ঞান, চিকিৎসা ও প্রযুক্তিবিষয়ক তথ্য ও অ্যানালিটিকস সংস্থা এলসেভিয়েরের যৌথ স্বীকৃতি।

অধ্যাপক সামিয়া সাবরিনা বলেন, ‘যন্ত্রের ক্ষেত্রে সবকিছু এখন আকারে ছোট হয়ে আসছে। ছোট বা ন্যানোস্কেলে উপাদানের বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন হয়। সেই পরিবর্তনকে বৈদ্যুতিক যন্ত্রে কীভাবে প্রয়োগ করা যায়, সেসব নিয়ে কাজ করছি।’

সে ক্ষেত্রে ল্যাপটপ কম্পিউটারের উদাহরণ টানেন তিনি। বলেন, ‘এখন সবাই হালকাপাতলা ল্যাপটপ ব্যবহার করতে চায়। একই সঙ্গে চায় ল্যাপটপে কাজ যেন দ্রুত করা যায়। এসব ক্ষেত্রে ল্যাপটপ চালানোর কিছু সময় পর তা গরম হয়ে যায় এবং ল্যাপটপের কার্যকারিতা ধীরগতির হয়ে যায়। এই তাপ যেন বহন করতে পারে, এমন “অ্যাটমিক স্কেল গ্রাফিন” প্রয়োগ করছি গ্রাফিনের বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনার মাধ্যমে। একইভাবে জ্বালানি সক্ষমতার ডিভাইস তৈরির উপাদান নিয়েও গবেষণা করছি।’

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, রিভারসাইড থেকে পিএইচডি করে ২০১১ সালে দেশে ফিরে আসেন সামিয়া সাবরিনা। শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস কৌশল বিভাগে। সামিরা সাবরিন বুয়েটের এই বিভাগ থেকেই স্নাতক হয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘দেশের অর্থে পড়েছি। তাই দেশকে কিছু দেওয়ার জন্য দেশে ফিরে এসেছি।’

প্রান্তিক কৃষকের কাছে সেবা পৌঁছাতে চান সালমা সুলতানা

প্রাণী চিকিতসক সালমা সুলতানা

শীর্ষ ১০০ বিজ্ঞানীর মধ্যে সালমা সুলতানা একজন। প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকদের প্রাণীর চিকিৎসায় অগ্রণী ভূমিকা রাখার জন্য গত বছর নরম্যান ই বোরল্যাগ পুরস্কার এবং ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ ফাউন্ডেশনের স্বীকৃতি পেয়েছিলেন তিনি। সেই সূত্রেই এশিয়ার ১০০ বিজ্ঞানীর তালিকায় তাঁর নাম।

সালমা সুলতানা দেশের প্রাণী চিকিৎসা বিষয়ক শিক্ষা বিস্তারে ও প্রাণী চিকিৎসায় ২০১৫ সালে রাজধানীর বনশ্রীর স্টাফ কোয়ার্টার রোডে গড়ে তুলেছেন মডেল লাইভস্টক ইনস্টিটিউট অ্যান্ড ভেটেরিনারি হাসপাতাল। এখানে গবাদি ও পোষা প্রাণী এবং পাখিগোত্রীয় সব প্রাণীর চিকিৎসা দেওয়া হয়। প্রাণী চিকিৎসার বিস্তারে তিনি গত ছয় বছরে তাঁর ইনস্টিটিউট থেকে গড়ে তুলেছেন চার শতাধিক ভেট নার্স বা প্রাণিসম্পদ স্বাস্থ্যসেবাকর্মী। ওই কর্মীরা ১২টি জেলায় প্রান্তিক কৃষকদের জন্য কাজ করছেন। দরিদ্র কৃষকেরা যেন তাঁদের প্রাণীদের জন্য বিনা মূল্যে সেবা পেতে পারেন, সে জন্য ২০১৬ সালে তিনি মডেল লাইভস্টক অ্যাডভান্সমেন্ট ফাউন্ডেশন গড়ে তোলেন। ২০১৮ সাল থেকে এটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) হিসেবে নিবন্ধন নিয়ে কাজ করছে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে গত তিন বছরে ১৩১ জন নারী কৃষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং পুনর্বাসনের জন্য একটি করে ছাগল দেওয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস ইউনিভার্সিটি থেকে ২০১৪ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা সালমা সুলতানা জানান, তাঁর সমস্ত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এ হাসপাতাল ঘিরে। সহায়তা পেলে নিজস্ব জমিতে আরও বড় ও আধুনিক স্থায়ী ক্যাম্পাস গড়ে তুলতে পারবেন।

সালমা বলেন, ‘আমাদের দেশের কৃষকদের অনেকেই পশু পালনের আধুনিক বিষয় সম্পর্কে জানেন না। গরু অসুস্থ হলে ওষুধ দিয়ে প্রাণীর সুস্থতার জন্য অপেক্ষা করেন না, কেটে মাংস বিক্রি করে ফেলেন। এমন অনেক ওষুধ আছে, যা খাওয়ানোর পর ২১ দিন পর্যন্ত ওই প্রাণীর মাংস খাওয়া যায় না। এটা মানুষের জন্য ক্ষতিকর। যে কারণে মানুষের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ভয়াবহভাবে বেড়ে যাচ্ছে। অনেকে জানেন না ভেন্টিলেশন, পানি ছিটানো এবং ছাদ ১৪ থেকে ১৮ ফুট উঁচু রাখলে গরুর বাসস্থানের তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা যায় এবং এটা গরুর উৎপাদনের জন্য ভালো।