বাঙালি নাচে অস্ট্রেলিয়া মাত!

তিন তরুণ তুর্কি—মাইনুল কাদির মাহিন, সম্প্রিতা চাকমা ও লামিয়া রাইদা চৌধুরী। তিনজনই পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে পরিচিত মুখ। এখানে তাঁদের খ্যাতি শীর্ষে। সাত সাগর তেরো নদীর পাড়ে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর রীতিমতো তারকা বনে যাওয়া! খানিকটা বিস্ময়করও বটে। ব্যাপারটা খোলাসা করা যাক।
দিনটি ছিল গত ১৬ অক্টোবর। ‘ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ান মাল্টি কালচারাল ফেস্টিভ্যাল’ মঞ্চ। বেজে চলেছে ‘ময়না ছলাৎ ছলাৎ রে/ পিছন পানে চায় না রে’। গানের সঙ্গে নাচছেন তিন শিল্পী। পরনের পোশাক ষোলোআনাই বাঙালি। মেয়েদের পরনে শাড়ি। ছেলের গায়ে পাঞ্জাবি। শিল্পীদের সঙ্গে কোমর দোলাচ্ছেন ভিনদেশি দর্শকেরাও। গানের কথা না বুঝলেও সংগীতের তালেই মজে যাচ্ছেন তাঁরা।
মঞ্চ মাতানো ওই পরিবেশনায় ছিলেন মাহিন, সম্প্রিতা ও লামিয়া। তিনজনই চট্টগ্রামের সন্তান। চট্টগ্রাম থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে পড়ছেন অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ে। মাহিন অ্যাকাউন্টিংয়ে, সম্প্রিতা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ভূগোলে এবং লামিয়া পড়ছেন নার্সিংয়ে।
সেদিন শুধু ‘ময়না ছলাৎ ছলাৎ’ নয়, মঞ্চ মাতিয়েছে ‘সোহাগ চাঁদ বদনি’, ‘এই শিকল পরা ছল’, ‘পাগলা হাওয়া,’ ‘শত আশা’ ও ‘চলো বাংলাদেশ’। প্রতিটি পরিবেশনা দর্শকদের নাচিয়েই ছেড়েছে। আর এমন পরিবেশনা স্বীকৃতি না পেয়ে িক পারে! দিন শেষে সেরার মুকুটই পরেছে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের দল। অবশ্য এই দলে চট্টগ্রামের তিনজন ছাড়াও সহশিল্পী হিসেবে ছিলেন আয়েশা মারজান, ফাবিহা অবন্তী ও জয় দেবনাথ। নাচের কোরিওগ্রাফি করেছেন নুসরাত জেরিন।
অস্ট্রেলিয়ার পার্থে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট কমিটি প্রতিবছর ‘পাসার মালাম’ নামের এই সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ৪১ দেশের শিক্ষার্থীরা নিজেদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা নিয়ে অংশ নেন এতে। চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় পরিবেশন করতে হয় হাজারো দর্শকের সামনে। এবার চূড়ান্ত পর্বে ছিল ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য। সবাইকে টপকে সেরা বাংলাদেশ।
২ ডিসেম্বর মুঠোফোনে কথা হয় মাহিনের সঙ্গে। মাহিন জানালেন, তাঁরা কেউই বাংলাদেশে থাকার সময় নাচ শেখেননি। তবে তাল সম্পর্কে ধারণা ছিল। কিন্তু তা পোক্ত না। অস্ট্রেলিয়া আসার পর পার্থে ফেস্টিভ্যালে নিজেদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে তাঁরা বেছে নেন নাচ।
বাকিটা শুনুন মাহিনের মুখে—‘আমাদের নাচের হাতেখড়ি দুই বছর আগে। যখন সিদ্ধান্ত নিই নাচ দিয়ে মাত করব আমরা। তিনজনই দৃঢ় ছিলাম আমাদের পারতেই হবে। সেই অদম্য ইচ্ছাশক্তিটা কাজ দিয়েছে। শুরু হলো প্রশিক্ষণ। আমার প্রশিক্ষক পার্থের বাংলাদেশি নৃত্যশিল্পী নুসরাত জেরিন। তাঁর আন্তরিকতায় খুব দ্রুত রপ্ত করতে পেরেছি নাচ। আমার কাছে মনে হয়েছে প্রবল ইচ্ছাশক্তির কাছে হার মানে সব। হয়তো আহামরি কিছু হয়নি। তারপরও নাচের মতো এমন কঠিন বিষয়েও আমরা উতরে গেছি। অন্তত দর্শকদের আনন্দ দিতে পেরেছি। দেশীয় সংস্কৃতিতে অন্যদের ছাড়িয়ে গেছি। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো অনুষ্ঠান হলেই আমাদের ডাক পড়ে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আমাদের একনামে চেনেন। এটাই বড় তৃপ্তি।’
সম্প্রিতা সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাসায় ফিরছেন। পথেই যেতে যেতে মুঠোফোনে কথা হয়। বললেন, ‘আমাদের পরিবেশনার সঙ্গে বাংলাদেশ নামটা উচ্চারিত হয় বারবার। এটা কী রকম ভালো লাগা তা বোঝাতে পারব না। আমরাও পরিবেশনায় সব সময় ফুটিয়ে তুলি দেশাত্মবোধ।’ লামিয়ার কাছে এই অর্জন গর্বের, আনন্দের।
বাংলাদেশে মাহিন পড়াশোনা করেছেন চট্টগ্রামের লিটল জুয়েলস স্কুলে, লামিয়া বেভিউ স্কুল ও সম্প্রিতা রাঙামাটি সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে।
তাঁদের মধ্যে সম্প্রিতা পড়ছেন অসএইড বৃত্তি নিয়ে। স্নাতকেও কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম শ্রেণি পাওয়ায় আরও এক বছর গবেষণা করার জন্য সরকারি বৃত্তি অর্জন করেছেন। এ ছাড়া গত বছর তিনি অর্জন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বেস্ট রাইজিং পারফরমার অ্যাওয়ার্ড’। লামিয়া কার্টিন ভলান্টিয়ারসের সঙ্গে বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে জড়িত। তাঁরা কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য।
তিনজনই পড়াশোনার পাশপাশি নাচ নিয়ে আরও এগোতে চান। আর তাঁদের পরিবেশনা মানেই বাংলাদেশ। বিদেশের বুকে উড়বে লাল-সবুজের পতাকা।