বাবার পারকার পেন

২৪ বছর আগের কথা। সন্ধ্যায় বাবার সঙ্গে হেঁটে ঢাকা নিউমার্কেটে যাচ্ছে সদ্য নাইনে ওঠা এক কিশোর। সারা দিন ব্যাংকের ম্যানেজারিয়াল দায়িত্ব শেষে ছেলেকে নিয়ে নিউমার্কেটে যাচ্ছেন বাবা। কয়েক দিন আগেই ক্লাস এইটের বৃত্তির রেজাল্ট দিয়েছে। যদিও স্কলারশিপ লিস্টে তার নাম কেন পেছনে, এসব নিয়ে হালকা বার্তা দিয়েছেন বাবা। কিন্তু সে যা–ই হোক, ছেলের এত চিন্তার কিছু নেই। কারণ, বৃত্তি তো সে পেয়েছে!

সেই সন্ধ্যায় নিউমার্কেটের আইডিয়াল আর অ্যাঞ্জেল নামের দোকানে ঢুঁ দেন বাবা-ছেলে। বাবা ঠিক করেছেন, ছেলেকে এবার একটু ভালো আর দামি কিছু দেবেন। দোকানে চমৎকার সব ফাউন্টেন পেন রাখা। ওয়াটারম্যান, মন্ট ব্লা, পারকার, পাইলটের সুন্দর সুন্দর মডেল সাজানো। কিন্তু ছেলে আর বাবার প্রথম পছন্দ আমেরিকান পারকার পেন। একটু দেখেশুনে তারপর চমৎকার নেভি ব্লু একটা পারকার ভেক্টর পেন কেনা হয় ৩০০ টাকায়। সেই চকচকে পারকার পেন আর পেলিক্যান কালি নিয়ে নিউমার্কেট থেকে রিকশায় চড়ে বাসায় আসার সময় কতবার যে প্যাকেটের মাঝে সেই পেন একটু একটু করে ছুঁয়ে দেখেছে ছেলেটা! সেই ছেলেই আমি।

আরও পড়ুন
লেখকের প্রিয় পারকার কলম
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

তারপর এসএসসি দিলাম, এইচএসসি দিলাম। দেশের ভার্সিটি থেকে বিদেশের ভার্সিটিতে পড়তে এলাম। মাস্টার্স শেষ হলো, পিএইচডি শেষ হলো। সেই একই কলম দিয়ে।

আমার ল্যাব ডেটা খাতা দেখে অনেকে বলত, ‘তুমি সেই আগের দিনের অধ্যাপকদের মতো লেখো।’ পিএইচডি কনভোকেশনের পর আমার সুপারভাইজার সোনালি এনগ্রেভ করা পারকারের আরেকটা মডেলের কলম গিফট করেছিলেন।

পিএইচডি শেষ করার পর এখন নিজেই মাস্টারমশাই বনে গেছি। কিন্তু সেই পারকার পেনটা আমি এখনো আগের মতো টেবিলে রাখি। এখন পারকারের বেশ কিছু মডেলের কলম আছে আমার। কিন্তু আজ থেকে ২২ বছর আগের কলমটা দিয়ে প্রায়ই লিখি। দীর্ঘদিন ব্যবহার করায় কলমের ক্যাপের কিছু অংশ ফেটে গেছে। কিন্তু তাতে কী, সেটাই কোনোরকমে জোড়া লাগিয়ে নিয়েছি।

মা–বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে লেখক (বাঁয়ে)
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

এখনো যখন কোনো গবেষণা গ্র্যান্টের আবেদনে স্বাক্ষর করি, সেই কলমেই করি। এখনো প্রতিদিন সকালে অফিসে বসে পারকার পেনটা হাতে নিয়ে যখন প্রজেক্ট প্ল্যান কিংবা নতুন কোনো গবেষণা নিবন্ধের খসড়া লিখি, মনে হয়, বাবা আমার আশপাশেই কোথাও আছেন। বাবা যদিও আমার কাছ থেকে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশে, কিন্তু এই কলম ছুঁয়ে যেন বাবাকে অনুভব করি আরও বেশি।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, লিনিয়াস বিশ্ববিদ্যালয়, কালমার, সুইডেন