বাবার যুদ্ধ

হাস্যোজ্জ্বল এক মুহূর্তে মুক্তিযুদ্ধা জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা (বাঁদিক থেকে) জিয়াউদ্দিন তারিক আলী, মফিদুল হক, রবিউল হুসাইন, আলী যাকের, ডা. সারওয়ার আলী, সারা যাকের, আক্কু চৌধুরী ও আসাদুজ্জামান নূর।ছবি: ইরেশ যাকের

মুক্তিযুদ্ধ বাবার সচেতন অথবা অবচেতন মনের খুব বেশি দূরে কখনোই থাকত না। বাবা চলে যাওয়ার সপ্তাহ দুয়েক আগে আমরা তিন দিনের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রতনপুরে আমাদের গ্রামের বাড়িতে যাই। তত দিনে বাবার শরীরটা বেশ খারাপ। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল খুব। বারবার পুবের আকাশ দেখিয়ে বলছিল, ‘একাত্তরে আমি ওই দিকে আগরতলা থেকে প্লেন টেকঅফ করা দেখতাম।’

মৃত্যুর মাস দুয়েক আগে একদিন বাবা মহান মুক্তিযুদ্ধের সব সেক্টর কমান্ডারের নাম মনে করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু পারছিল না। বাবা আমার দেখা সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষদের একজন। সেই বাবা যখন সেক্টর কমান্ডারদের নাম মনে করতে পারল না, তখন বুঝলাম ও ঠিক কতটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। শক্তি যা অবশিষ্ট আছে, ব্যয় করছে বেঁচে থাকার জন্য। সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার জন্য।

দেখলাম আরেক যুদ্ধ

একাত্তরের যুদ্ধে বাবাকে আমি দেখিনি। বাবার জীবনের কষ্টের সময়গুলো বেশির ভাগ কেটেছে আমার জন্মের আগে অথবা আমি খুব ছোট থাকতে। তবে গত চার বছর আমি বাবাকে যুদ্ধ করতে দেখেছি।

বাবার প্রথম ক্যানসার ধরা পড়ল চার বছর আগে। ডিসেম্বর মাসে ঠিক এ রকম সময়। সিঙ্গাপুরে। বাবার সঙ্গে মা (সারা যাকের) আর আমার বোন (শ্রিয়া সর্বজয়া) ছিল। কথা ছিল যে ডাক্তার যদি খুব খারাপ কোনো খবর দেয়, আমি যাব। এক দিনের মাথায় ক্যানসার ধরা পড়ল। আমি সেদিনই চলে গেলাম। পৌঁছালাম ভোরে। সকালে বাবা ঘুম থেকে ওঠার পর বেশ নির্লিপ্ত মনে হলো। তারপর দুই দিন এক ডাক্তার থেকে আরেক ডাক্তারের কাছে ছোটাছুটি। বুঝলাম অবস্থা বেশ শোচনীয়। ক্যানসারের লেট থার্ড স্টেজ। পাকস্থলীতে প্রায় সাত সেন্টিমিটার লম্বা একটা টিউমার। জটিল অপারেশন। অপারেশনের পর ১২ রাউন্ড কেমোথেরাপি দিতে হবে। বাবা নিশ্চয়ই অনেক ভয় পেয়েছিল। তবে ভয় পেলেও আমাদের বুঝতে দেয়নি। সে কারণেই হয়তো আমরা নিজদের শক্ত রাখতে পেরেছিলাম।

বাবা সিঙ্গাপুরের সমুদ্রসৈকতে, পার্কে যেতে ভালোবাসত। অপারেশনের আগে আমরা প্রায় প্রতিদিন পার্কে যেতাম। অপারেশনের ঠিক আগের দিন বাবা পার্কের ঘাসে শুয়ে পড়ল। শুয়ে অনেকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল। বুঝতে পারলাম যে বাবা একটু হলেও মৃত্যুর ব্যাপারে চিন্তিত। এর বাইরে উৎকণ্ঠার কোনো চিহ্ন আমি দেখিনি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী যাকের (৬ নভেম্বর ১৯৪৪–২৭ নভেম্বর ২০২০)।
ছবি: কবির হোসেন

দেশে কবে ফিরব

অপারেশন সফল হলো। তারপর দীর্ঘদিন ধরে পোস্ট অপারেটিভ কেয়ার। সিঙ্গাপুরে থাকতে হলো অনেক দিন। অপারেশনের কারণে পেটে ১৪ ইঞ্চি একটা দাগ থেকে গেল। সেই দাগের ব্যাপারে বাবার শেষ পর্যন্ত একটা অহংকার ছিল। যেন যুদ্ধে অর্জিত ক্ষত। হয়তো তা-ই। ওই সময়েও বাবাকে কোনো শারীরিক বিষয়, কোনো ব্যথা নিয়ে কখনো কোনো কিছু বলতে শুনেছি বলে মনে পড়ে না। শুধু একটাই নালিশ। দেশে কবে ফেরত যাবে। বাবা দেশে ফিরল প্রায় দুই মাস পর।

অপারেশনে বাবার অর্ধেকের বেশি পাকস্থলী কেটে ফেলে দিতে হয়। এতে বাবার খাওয়াদাওয়া করার ক্ষমতা অনেকটাই কমে যায়। বাবার মতো ভোজনবিলাসী মানুষের জন্য বিষয়টা নিশ্চয় পীড়াদায়ক ছিল। তবে বাকি সবকিছুর মতো এই বিষয়টিও বাবা একটা চ্যালেঞ্জের মতো করে নিল। এমন ভাব যে খাওয়াদাওয়া করা খুব খারাপ জিনিস। এটা না করতে পেরেই সে খুশি।

মঞ্চের টানে

এর পর প্রায় এক বছর ধরে বাবার কেমোথেরাপি চলল। শরীর প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়ল। দরাজ গলা ক্ষীণ হয়ে গেল। ওজন প্রায় ৩০ কেজি কমে গেল। জামাগুলো ঢোলা হয়ে গেল। সেই ঢোলা স্যুট পরেই বাবা অফিসে গেল। অসাধারণ অন্তর্গত মাধুর্য ও আত্মবিশ্বাসের কারণেই হয়তো এই ঢোলা কাপড়েও বাবাকে বেশ মানিয়ে গেল। এত কিছুর পরেও বাবার কোনো নালিশ নেই।

কেমোথেরাপি শেষে ডাক্তার টেস্ট করে বলল যে আপাতত বাবার শরীরে ক্যানসার নেই। ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসের কথা।

পাঁচ মাসের মাথায় বাবা মঞ্চে উঠল। গ্যালিলিও নাটকের একটা ১৫ মিনিটের সংক্ষিপ্ত মঞ্চায়নের জন্য। অবিশ্বাস্য মনে হলো আমার কাছে। বাবার বয়সে এত দীর্ঘ এবং দুর্বিষহ চিকিৎসার পর এত কম সময়ের মধ্যে কারও মঞ্চে অভিনয় করতে পারার কথা না। আমাদের আরও আশ্চর্য করে বাবা ঘোষণা দিল যে অক্টোবর মাসের মধ্যে সে গ্যালিলিও নাটকের পুরোটা মঞ্চায়ন করবে এবং করলও তাই।

২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৯-এর মার্চ পর্যন্ত গ্যালিলিও সাতবার মঞ্চায়িত হলো। শেষ মঞ্চায়নের সময় আমরা বুঝতে পারলাম যে বাবার শরীরটা আবার দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে ডাক্তার মনে করলেন যে কিডনি ও হার্টের সমস্যা। তিন মাস পরপর যে ক্যানসার স্ক্যান করতে হয়, সেটা করে দেখা গেল যে বাবার ক্যানসার ফেরত এসেছে। ফেরত এসেছে বললে ভুল হবে। ক্যানসার শরীরের ভেতরেই ছিল। সুপ্ত ছিল। জেগে উঠেছে। যেখানে ছিল সেখান থেকে ছড়ানো শুরু করেছে। চিকিৎসাশাস্ত্রে এটাকে মেটাসটেসিস বলে। একবার হলে সারানোর উপায় নেই। কিছুদিন নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। কিন্তু সারানো সম্ভব না। ডাক্তার বলল, বাবার মতো কেসে সাধারণত রোগী ছয় মাসের বেশি বাঁচে না।

আমার বিশ্বাস যে পুরো বিষয়টা বাবা শুরু থেকেই বুঝেছিল। কিন্তু অসুখ যে ঠিক হবে না, সেটা বাবা এক সেকেন্ডের জন্য স্বীকার করতে চায়নি। ছয় মাস ক্যানসারকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কেমোথেরাপি নিল। শরীরের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ইমিউনোথেরাপি নিল। একপর্যায়ে শরীর এত দুর্বল হয়ে গেল যে কেমোথেরাপি দেওয়া অসম্ভব হয়ে গেল। এতই দুর্বল যে ডাক্তার আমাদের বলে দিল বাবার মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হতে। সেটা ২০১৯-এর নভেম্বর মাসের কথা।

কেমোথেরাপির ধকল থামার পর বাবা খানিকটা সবল হলো। ধীরে ধীরে ওয়াকার ব্যবহার করে নিজে নিজে হাঁটা শুরু করল। গাড়িতে চড়ে একটু বাইরেও গেল। তত দিনে আমার কন্যা মেহা এবং আমার ভাগনে এয়ানের ছয় আর আট মাস বয়স। ওদের সঙ্গে সময় উপভোগ করার ক্ষমতা ফিরে পেল বাবা। এই সময় সারা পৃথিবীতে শুরু হলো করোনাভাইরাসের সংক্রমণ।

সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার সময় বাবা আলী যাকের ছেলের ক্যামেরায়

বাবাই নূরলদীন

মূলত বাবার কথা চিন্তা করেই করোনাকালে আমরা প্রায় গৃহবন্দী হয়ে গেলাম। মজার বিষয় যে লকডাউন, কোয়ারেন্টিন কোনোটাই কোনোভাবে বোঝানো গেল না বাবাকে। খালি বেরিয়ে যেতে চায়। গাড়িতে করে পূর্বাচল চলে যায়। মেয়ের বাসায় চলে যায় নাতিকে দেখতে। কোনোভাবেই ঘরে রাখা যায় না। একটু একটু করে বাবার স্বাস্থ্য ভালো হওয়াও শুরু করল। এমনকি আমরা বাসায় বসেই নূরলদীনের একটা দৃশ্য চিত্রায়ণ করে ফেললাম। বেশ সাড়া ফেলল বাবার সেই অভিনয়। বাবা বলল, আরও কিছু দৃশ্য শুট করতে চায়। কোথায় যেন একটা আশার আলো দেখতে পেলাম। বাবা হয়তো এভাবেই আর বেশ কিছুদিন কাটিয়ে দেবে। কিছু মিরাকল কেসে যে রকম হয়। করোনার কারণে বাবার ক্যানসার পরীক্ষা বন্ধ হয়ে গেল। ডাক্তার বলল, যেহেতু কোনো চিকিৎসা নেই টেস্ট করে করোনা বাধানোর ঝুঁকি নেওয়ার কোনো অর্থ হয় না। যে রকম আছে থাকুক। অক্টোবরের দিকে বাবার শরীর আবার খারাপের দিকে যাওয়া শুরু করল। স্ক্যান না করে কেবল রক্ত পরীক্ষাতেই বোঝা গেল যে ক্যানসার বেশ ছড়িয়ে গেছে।

নিজের বাড়ি রতনপুরে মৃত্যুর কয়েক দিন আগে বাবার এই ছবিটি তুলেছিলেন ইরেশ যাকের

রতনপুর বারবার

চলে যাওয়ার আগে রতনপুর না দেখলে বাবা কষ্ট পাবে। তাই আমরা অক্টোবর-নভেম্বর মাসে দুবার গ্রামের বাড়িতে গেলাম। শেষবারের মতো রতনপুর থেকে ফেরার তিন দিনের মাথায় বাবার কিডনি ফেইল করা শুরু করল। হাসপাতালে গেল। এক সপ্তাহ থেকে বাসায় আসতে চাইল। আবার এক দিন পরে হাসপাতালে যেতে হলো। ওই শেষ যাওয়া।

আমার এই লেখা পড়ে মনে হতে পারে যে বাবার কষ্ট আমি অনেকটা বুঝতে পারছিলাম। সেটা ভুল হবে। কিছু ক্ষেত্রে আমি বুঝতে চাইনি। কিছু ক্ষেত্রে আমি বুঝতে পারিনি। আবার কিছু ক্ষেত্রে বাবা আমাকে বুঝতে দেয়নি। কিছু ক্ষেত্রে অস্বীকার করার উপায় ছিল না।

শেষের দিকে বাবার চোখগুলো বড় হয়ে গেছিল। অসম্ভব কষ্টে যে রকম হয়। তারপরও আমার তোলা বাবার শেষ ছবিতে সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে চাহনিতে আগের সেই প্রশান্তি, সেই শক্তি ফিরিয়ে আনতে।

যেদিন চলে যায়। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ফুসফুস আর কাজ করছে না। ডাক্তার আসার পর বাবা চেষ্টা করেছে মাথা তুলে বসার জন্য। ভিডিও কলে আমার মেয়ে মেহাকে দেখে ‘হাই আপুজি’ বলেছে। আমি যখন বলেছি, ‘আই লাভ ইউ’, আমাকে বলেছে ‘আই লাভ ইউ টু’। ক্যানসারের ব্যথায় কিছুক্ষণ পরপর শরীর কেঁপে উঠছে, তারই মধ্যে যখন ডাক্তার জিজ্ঞেস করেছে কেমন আছেন, বাবা বলেছে ‘আমি ভালো আছি।’ বাবার যে প্রাইমারি ফিজিশিয়ান ওনাকে নাকি বাবা কখনোই বলেনি, ‘আমি ভালো নেই।’ আমাদেরও না। মাকে হয়তো একবার বলেছে, ‘আমি মনে হয় ভালো নাই।’ গত দুই বছরে একবার।

মৃত্যুর কয়েক মাস আগে একদিন আমার কোনো কারণে মন খারাপ ছিল। বাবা বলেছিল, ‘মন খারাপ কোরো না। আমি তো আছি।’ তখন আমার খুব জেদ হয়েছিল। বলতে ইচ্ছা করেছিল, ‘তুমি তো আর দুই দিন পরে থাকবে না। তখন আমার কী হবে।’ ভাগ্যিস বলিনি।

যেকোনো যুদ্ধে লড়াই করতে গেলে প্রচুর বিশ্বাসের প্রয়োজন। বাবা বিশ্বাস করত যে সে ভালো আছে, ভালো থাকবে। নিজের জন্য। আমাদের জন্য। তাই জীবনের রণক্ষেত্র থেকে বেঁচে না ফিরলেও বাবা পরাজিত হয়নি।

আমি একাত্তরে বাবাকে দেখিনি। কিন্তু বাবাকে আমি লড়তে দেখেছি।