বালুর ব্যাগে আলোকিত ঘর

উন্নয়নশীল দেশের মানুষের জন্য খুবই কার্যকর গ্র্যাভিটিলাইট
উন্নয়নশীল দেশের মানুষের জন্য খুবই কার্যকর গ্র্যাভিটিলাইট

মার্টিন রিডিফোর্ড আর জিম রিভস। যুক্তরাজ্যের দুজন প্রোডাক্ট ডিজাইন পরামর্শক। তাঁদের একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল দাতব্য সংস্থা সোলারএইড। সোলার প্যানেল ও ব্যাটারিসহ এমন একটি বাতি তৈরি করতে হবে, যার দাম হবে ছয় ডলারের কম বা প্রায় সাড়ে ৪০০ টাকা। উদ্দেশ্য, উন্নয়নশীল দেশের মানুষের জন্য কেরোসিনের বিকল্প তৈরি করা। কেননা কেরোসিন নোংরা, বিষাক্ত ও বিপজ্জনক। তার ওপর দামি।
কথামতো কাজে নামলেন দুই মেধাবী ডিজাইনার। দিনরাত খাটনির পরও দেখা গেল, ফলাফল শূন্য। কারণ, অল্প টাকায় সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সঞ্চয় করা এবং রাতে তা সরবরাহ করার মতো যন্ত্র বানানো অসম্ভব। তখন থেকেই তাঁরা ভাবতে শুরু করলেন এমন একটা বাতির কথা, যা সহজে তাৎক্ষণিকভাবে আলো তৈরি করতে পারবে।

গ্র্যাভিটিলাইটের সুফল পাচ্ছে দরিদ্র দেশের মানুষেরা
গ্র্যাভিটিলাইটের সুফল পাচ্ছে দরিদ্র দেশের মানুষেরা

‘শক্তির বিভিন্ন ব্যয়বহুল উৎসের পরিবর্তে কীভাবে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ব্যবহার করে একটা কিছু তৈরি করা যায়, সেটাই ছিল ভাবনায়।’ বলছিলেন রিভস। ‘এক বস্তা পাথর বা আবর্জনা ব্যবহার করেও প্রয়োজনীয় শক্তিটুকু তৈরি করে নেওয়া যায়।’ ভাবনা অনুযায়ী কাজে নেমেছিলেন দুজন। এবার সুফল পেয়েছেন দ্রুতই। ‘মার্টিনই প্রথম নিশ্চিত করেছিল, এটা সম্ভব।’ রিভস বলেন।
মূল যন্ত্রাংশটির ওজন এক কেজিরও কম। অনেকটা ডিম্বাকৃতির। দেখতে অনেকটা মাছ ধরার যন্ত্রের মতো। ১০ কেজি ওজনের পাথর, বালু বা সহজলভ্য যেকোনো কিছু যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ব্যাগের ভেতর ভরে অপর পাশের হুকটি টেনে দিলে এটি কাজ করতে শুরু করে। রিভস বলেন, ‘এটি মৃদু শব্দ করে। তবে সেটা শোনা যায় না বললেই চলে।’ বাতি জ্বালানো ছাড়াও এটি টর্চ বা রেডিও চার্জ করার কাজেও ব্যবহার করা যায়।
২০১২ সালেও গ্র্যাভিটিলাইট নিয়ে খুব বেশি দূর যাওয়া যাবে না বলে মনে হচ্ছিল। প্রকল্পটি এগিয়ে নিতে প্রয়োজন ছিল আবিষ্কারকদের একটি তহবিল, যার মাধ্যমে আফ্রিকা ও ভারতের এক হাজার পরিবারে বাতিটি পৌঁছে দেওয়া যায়। কারণ, ২০ মিনিটের আলোর জন্য লোকজন প্রতিবার ১০ কেজি ওজনের একটি ব্যাগ তুলতে রাজি আছে কি না, সেটাও ছিল ভাবনার বিষয়।
ইনডিয়েগোগোর মাধ্যমে রিভস আর রিডিফোর্ড তহবিল গঠন শুরু করেন। শুরুতেই যে সাড়া তাঁরা পেয়েছেন, তা ছিল সত্যিই অবাক করার মতো। মাত্র চার দিনে জমা হয়েছিল ৫০ হাজার ডলার। সে অঙ্ক দিনে দিনে বেড়েছে। বিল গেটস গ্র্যাভিটিলাইট সম্পর্কে টুইট করার পর মানুষের আগ্রহ বেড়ে গিয়েছিল বহুগুণ। তাঁর ৯২ লাখ অনুসারীর কাছে খুব দ্রুতই পৌঁছে গেছে খবর, ‘গ্র্যাভিটিলাইট এক দারুণ আবিষ্কার’। ফলাফল: মাত্র ৪০ দিনে তহবিলে জমা পড়েছিল চার লাখ ডলার।
মাঠপর্যায়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে ২৭টি দেশে, পেরু থেকে ফিলিপাইন অবধি। এ কাজে সাহায্য করেছে বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও সহযোগী সংস্থা। শ্রীলঙ্কা ঘুরে এসে রিডিফোর্ড বুঝেছিলেন, গ্র্যাভিটিলাইটের আলো হুট করেই নিভে যায়। ব্যাগের আকৃতি বদলে তাঁরা গ্র্যাভিটিলাইটকে করে তুললেন আরও নিখঁুত। কিছুটা নতুনত্ব সংযোজনের পর দেখা গেল, আলোটা ধীরে ধীরে কমে গিয়ে পুরোপুরি নিভে যেতে ৬০ সেকেন্ড সময় লাগে।
২০১৫ সাল নাগাদ বাজারে গ্র্যাভিটিলাইট সহজলভ্য হয়ে ওঠার কথা। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এর দাম হবে আট শ টাকার কিছু কম। রিডিফোর্ড আর রিভস লাভের অঙ্কটা তুলতে চাইছেন মূলত পশ্চিমা বাজার থেকে। ইতিমধ্যেই তাঁরা বিভিন্ন সুপার মার্কেট ও দোকানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।
যে প্রকল্প শুরুতে ব্যর্থ হবে বলে মনে হচ্ছিল, সেটিই আজ নতুন গতি পেয়েছে। পরিণত হয়েছে এক বিশ্বব্যাপী মিশনে।

গ্র্যাভিটিলাইট, দারুণ এক উদ্ভাবন
গ্র্যাভিটিলাইট, দারুণ এক উদ্ভাবন