বাল্যবিবাহ রোধে টেকসই পদক্ষেপে

অলংকরণ: আরাফাত করিম

বাল্যবিবাহ একটি সামাজিক ব্যাধি আর এর প্রধান শিকার কিশোরীরা। এ দেশে ৫৯ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় ১৮ বছর হওয়ার আগে। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী বাল্যবিবাহের হারে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। আইন থাকা সত্ত্বেও দেশে উদ্বেগজনক হারে বাল্যবিবাহ বেড়েই চলেছে। এটা এখন রীতিমতো আমাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হলো এসকেএফ নিবেদিত বিশেষ অনুষ্ঠান ‘আমাদের যত মাথাব্যথা’র তৃতীয় পর্বে।

প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানার সঞ্চারনায় অতিথি ছিলেন ময়মনসিংহ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ফরিদা ইয়াসমিন, কেয়ার বাংলাদেশের জেন্ডার মেইনস্ট্রিমিং শাখার সিনিয়র টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর রওনক জাহান এবং ঢাকা মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থী তুলি দেবনাথ

অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে ছিলেন ময়মনসিংহ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ফরিদা ইয়াসমিন, কেয়ার বাংলাদেশের জেন্ডার মেইনস্ট্রিমিং শাখার সিনিয়র টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর রওনক জাহান এবং ঢাকা মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থী তুলি দেবনাথ। সঞ্চালনায় ছিলেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।

অনুষ্ঠানটি ২৬ অক্টোবর প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ এবং ইউটিউব চ্যানেল এবং এসকেএফের অফিশিয়াল ফেসবুক থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

আলোচনার শুরুতেই রওনক জাহান বলেন, সবাই মোটামুটি জানে যে বাল্যবিবাহ হলে কী হতে পারে; কিন্তু একটি মেয়ের পেছনে বিনিয়োগ করলে, তাকে পড়াশোনা করিয়ে দেরিতে বিয়ে দিলে কী হবে, সে বিষয়ে কেউ সচেতন নয়।

বাল্যবিবাহ রোধে সরকারসহ বেসরকারি সংগঠনগুলো বেশ সক্রিয়ভাবে কাজ করছে, তবে একসঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করা জরুরি। কারণ কিছু সংগঠন আছে যারা এটি বন্ধে একটু ভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে, যা সমাজে টেকসই পরিবর্তন আনতে পারে।

অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থী তুলি দেবনাথের ওপর নির্মিত ‘সাত সাহসী’ নামের একটি তথ্যচিত্র দেখানো হয়। সেখানে তুলি নিজের স্কুলের ছয়জন বান্ধবীকে নিয়ে কীভাবে নানা সমস্যা উপেক্ষা করে বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছেন, সেই চিত্র তুলে ধরা হয়। যেসব শিশু-কিশোরী পড়াশোনা করে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে, তাদের বাল্যবিবাহ বন্ধ করে স্বপ্নপূরণে সহায়তা করাকে নিজের জীবনের একটি বড় অর্জন হিসেবে দেখেন তিনি।

অনেক সময় দেখা যায় মা-বাবা চান না মেয়ের বিয়ে দিতে কিন্তু এলাকা বা গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের চাপে পড়ে বিয়ে দিতে বাধ্য হন। রওনক জাহানের মতে, এই গণ্যমান্য ব্যক্তিরাই পারেন বাল্যবিবাহ রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে। যদি তাঁরা তাঁদের জায়গা থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করেন, তাহলে সহজে এটি রোধ সম্ভব হবে।

এ ছাড়া তিনি বলেন, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ প্রণয়নের আগে তাঁদের সংগঠনসহ যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান শিশুবিবাহ রোধে কাজ করছে, তাদের সঙ্গে বসে সরকার অনেক আলোচনা করে। বাল্যবিবাহ রোধে সরকারসহ বেসরকারি সংগঠনগুলো বেশ সক্রিয়ভাবে কাজ করছে, তবে একসঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করা জরুরি। কারণ কিছু সংগঠন আছে যারা এটি বন্ধে একটু ভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে, যা সমাজে টেকসই পরিবর্তন আনতে পারে। তাদের পন্থাগুলো সরকার গ্রহণ করলে এবং অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গে মিলে কাজ করলে দ্রুত বাংলাদেশ থেকে শিশুবিবাহ নির্মূল করা সম্ভব হবে।

আগে একটি ধারণা ছিল, শিক্ষিত পরিবারে বাল্যবিবাহ হয় না। রওনক জাহান নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, এটি মোটেও সঠিক নয়। কারণ অনেক শিক্ষিত অভিভাবক অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন আবার এমনও দেখা গেছে, অনেক গরিব স্বল্পশিক্ষিত মা-বাবা তাঁদের মেয়েকে কষ্ট করে হলেও লেখাপড়া করাচ্ছেন।

বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে গিয়ে কোন সমস্যার সম্মুখীন হলে ১০৯৮১০৯ ও ৩৩৩ সরকারি টোলফ্রি নম্বরে ফোন দিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের সাহায্য নেওয়া যাবে।

বাল্যবিবাহ নিরোধে বিশেষ ভূমিকার জন্য ফরিদা ইয়াসমিনকে ২০১৯ সালে ফারাজ হোসেন সাহসিকতা পুরস্কার দেওয়া হয়। এ অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে মেয়েদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিই শিশুবিবাহের প্রধান কারণ। মেয়েরা স্বাবলম্বী হয়ে মা-বাবার অর্থনৈতিক অবলম্বন হতে পারে, এ ধারণা আমাদের দেশে স্বীকৃত নয়। সুযোগ্য পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে সমাজে একটি অবস্থান তৈরি করার জন্যও কিন্তু কিশোরী মেয়েকে বিয়ে দেওয়া হয়।’ এখন আমাদের দেশের সবাই জানেন বাল্যবিবাহ দেওয়া একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই এটি বন্ধ করতে গিয়ে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে খুব একটা বাধার সম্মুখীন হননি ফরিদা ইয়াসমিন। তবে, ‘অনেক টাকা খরচ হয়েছে বিয়ের আয়োজন করতে, বিয়ে না হলে মেয়েটিকে সমাজ কীভাবে নেবে, এই মেয়েটিকে ছেড়ে দিন, আমাদের মহল্লায় আর কখনো এমন হবে না।’ প্রভৃতি নানা কথা বলে মানসিকভাবে দুর্বল করার চেষ্টা করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

কোনো এলাকায় বাল্যবিবাহ বন্ধের জন্য ইউএনও, মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা, সমাজসেবা কর্মকর্তা, শিক্ষা কর্মকর্তা, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বারকে খবর দেওয়া যাবে বলে জানান ফরিদা ইয়াসমিন।

অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যারা বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে চেয়েছে বা করেছে, তারা নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। এমন সমস্যার মুখে পড়লে ১০৯৮১০৯ ও ৩৩৩ সরকারি টোলফ্রি নম্বরে ফোন দিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের সাহায্য নেওয়া যাবে বলে জানান ফরিদা ইয়াসমিন ও তুলি দেবনাথ। যিনি ফোন করছেন তাঁর নাম গোপন রেখেই বাল্যবিবাহ বন্ধে সহযোগিতা করতে পারেন। তবে এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে সচেতনতা ও সাহসিকতার কোনো বিকল্প নেই।

আমাদের দেশে বাল্যবিবাহ বন্ধ হওয়ার প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ভীত না হয়ে মেয়েদের আরও বেশি সাহসী হতে হবে এবং বাল্যবিবাহ বন্ধে সমাজের সচেতন নাগরিকদের এগিয়ে আসতে হবে। এভাবেই দেশ থেকে বাল্যবিবাহ দূর হতে পারে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন অতিথিরা।