বিজ্ঞানীর নাচের স্কুল
সুবর্ণা আফরিন খান পেশায় ক্যানসারবিজ্ঞানী। আর নাচ তাঁর নেশা। যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সিতে তাঁর নাচের একটা স্কুলও আছে। সেখানে নাচে নাচে শিশুদের শেখানো হয় বাংলাদেশের ঐতিহ্য। তাঁর গল্প শুনেছেন নাজনীন আখতার
প্রায় দুই যুগ আগের কথা। শাড়ি আর ভারী গয়না পরে যুক্তরাষ্ট্রের একটা স্কুলে নাচ শেখাতে হাজির হয়েছেন সুবর্ণা আফরিন খান। তরুণী আফরিনকে দেখে স্কুলের শিশুরা ভীষণ অবাক। নাচের মুদ্রায় আকাশ, ফুল, পাখি ফুটিয়ে তুলতে শিখে তাদের বিস্ময় আরও বেড়েছিল। আফরিনের সঙ্গে থাকা চড়া রঙে চিত্রিত রিকশার রঙিন ছবি তাদের অভিভূত করেছিল।
আজও এভাবেই তিনি শিশুদের মুগ্ধ করেন। দেশের সংস্কৃতি পরবাসে শিশুদের কাছে তুলে ধরেন। নৃত্যশিল্পী হিসেবে সৃজনশীলতার মাধ্যমে মানুষের মন ও মননকে বিকশিত করার চেষ্টা করেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সিতে ১৬ বছর ধরে ‘সৃষ্টি একাডেমি অব পারফর্মিং আর্টস’ নামের একটি নিবন্ধিত নাচের স্কুলও পরিচালনা করছেন আফরিন। অথচ তিনি পেশায় একজন ক্যানসারবিজ্ঞানী। ১৫ বছর ধরে ক্যানসার–বিষয়ক নানা গবেষণার সঙ্গে যুক্ত আছেন আফরিন।
হোয়াটসঅ্যাপে সুবর্ণা আফরিনের সঙ্গে কথা হলো। প্রবাসে নাচের স্কুল প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘প্রশিক্ষিত নৃত্যশিল্পী তৈরি করতে এবং যুক্তরাষ্ট্রে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের সঙ্গে বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সংযোগ স্থাপন করতেই এ উদ্যোগ নিই। দেশ ছেড়ে এলেও নাচ থেকে কখনো দূরে থাকিনি, বলা ভালো, থাকতে পারিনি।’
তাঁর স্কুল থেকে এখন পর্যন্ত ১০ জন নাচের ওপর ডিপ্লোমা করেছেন। এখনো ১০ জন নাচ শিখছেন। তাঁর পরিচালনায় উত্তর আমেরিকায় বাংলাদেশি সংগঠন দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশি অ্যাসোসিয়েশনস ইন নর্থ আমেরিকা (ফোবানা), উত্তর আমেরিকা বাঙালি সম্মেলন বা বঙ্গ সম্মেলন (এনএবিসি), নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন এবং বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল কার্যালয় আয়োজিত বৈশাখী অনুষ্ঠান, নিউইয়র্কে সোসাইটি অব ফরেন কনস্যুলেটস আয়োজিত আন্তর্জাতিক খাদ্য উৎসব, আন্তর্জাতিক নারী দিবস ইত্যাদি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সৃষ্টি একাডেমির শিল্পীরা নিয়মিত নৃত্য পরিবেশন করেন। নাচার এ সুযোগকে সৌভাগ্য বলে মনে করেন সুবর্ণা। তিনি বলছিলেন, ‘নানা দেশের নৃত্যশিল্পীরা যোগ দেন এসব অনুষ্ঠানে। অন্য দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। তারাও আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হন। একধরনের সাংস্কৃতিক বিনিময় ঘটে।’
শৈশবে নৃত্যশিল্পী আলপনা মমতাজের কাছে লোকনৃত্যে সুবর্ণা আফরিনের হাতেখড়ি। নৃত্য গবেষক ও নৃত্যশিল্পী লুবনা মরিয়মের নামটি উল্লেখ করে আফরিন বললেন, ‘তিনিই আমাকে রাবীন্দ্রিক নৃত্যভঙ্গিমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।’ ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের চারটি ধারার মধ্যে তিনটিতেই (মণিপুরী, কত্থক ও ভরতনাট্যম) তাঁর বিচরণ রয়েছে। তিনি ছায়ানটে মণিপুরী শিখেছেন, কত্থক শিখেছেন নৃত্যশিল্পী শিবলী মোহাম্মদের কাছে আর ভরতনাট্যম বেলায়েত হোসেন খানের কাছে। ভরতনাট্যমে আরও বিশদ তালিম নেন সোমা মমতাজের কাছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অণুজীববিজ্ঞানে স্নাতক করেছেন সুবর্ণা আফরিন। উচ্চতর ডিগ্রির জন্য ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান তিনি। সেখানেও নাচ নিয়ে কাজের সুযোগ পান তিনি। সে সময় অরিগনের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য সাংস্কৃতিক বৃত্তি দেওয়া হয়েছিল। সেই বৃত্তির আওতায় স্কুলসহ বিভিন্ন সংস্থায় নাচ ও দেশের ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে পরিচয় করিয়ে দিতে ঘুরে বেড়াতেন সুবর্ণা।
বর্তমানে স্বামী শামসুল সাদী এবং দুই পুত্র কীয়ান সাদী ও ঈশান সাদীকে নিয়ে নিউজার্সিতে থাকেন সুবর্ণা আফরিন। যুক্তরাষ্ট্রে অণুজীববিজ্ঞান ও জীবাণুবিজ্ঞান জিনতত্ত্বের ওপর রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং পরবর্তী সময়ে পিএইচডি করেন। বর্তমানে নোভারটিস ফার্মাসিউটিক্যালসে সহযোগী পরিচালক (কোষ ও জিন থেরাপি) হিসেবে কর্মরত আছেন।
রাজনৈতিক আবহে বেড়ে উঠেছেন সুবর্ণা আফরিন। বাবা বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন, মা সংসদ সদস্য লুৎফুন নেসা খান। নাচ নিয়ে আগ্রহ পরিবার থেকেই তৈরি হয়েছে। বিজ্ঞানী ও নৃত্যশিল্পী পরিচয় দুটি দুই মেরুর মনে হতে পারে অনেকের কাছে। সুবর্ণা বলেন, এ প্রশ্নই সবচেয়ে বেশি শোনেন তিনি। তবে ভিন্নভাবে দুটিকেই তাঁর সৃষ্টিশীল কাজ মনে হয়। পরিবারের একটি বড় শোকের ঘটনা তাঁকে ক্যানসারবিজ্ঞানী হতে তাগিদ দিয়েছে। ক্যানসারের ওষুধ নিয়ে ক্রমাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা তাঁর কাছে সৃজনশীল কাজ। সেই ওষুধ ক্যানসার রোগীদের সুস্থ করে তুললে আনন্দে ভাসেন। নাচের মধ্যেও তেমন আনন্দই খুঁজে পান।
সুবর্ণা বললেন, ‘নাচ আমার অক্সিজেন। নাচের মাধ্যমে বিশ্ব আঙিনায় বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তুলে ধরাকে অব্যাহত রাখতে চাই।’