বিদেশে সেকেন্ড হোম

সচ্ছল, প্রতিষ্ঠিত পরিবারও সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ‘সেকেন্ড হোম’ গড়তে উন্নত দেশে যেতে চান। ছবিটি প্রতীকী
সচ্ছল, প্রতিষ্ঠিত পরিবারও সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ‘সেকেন্ড হোম’ গড়তে উন্নত দেশে যেতে চান। ছবিটি প্রতীকী

এই তো, কোনো এক সুন্দর সকালে ফেসবুক খুলতেই চোখে পড়ল সগীর আহমেদের প্রোফাইল। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ‘চেক-ইন’ দিয়েছেন। লাউঞ্জে বসে অপেক্ষা করছেন বিমানে উড়াল দেওয়ার। সঙ্গে স্ত্রী আর দুই সন্তান। যাচ্ছেন কানাডা। কয়েক ঘণ্টা পর দোহা বিমানবন্দর থেকেও চারজনের হাস্যোজ্জ্বল ছবি পোস্ট করলেন। দুদিন পর কানাডার এক নয়নাভিরাম হ্রদের পাড়ে এই পরিবারের ছবি।

সগীর আহমেদ (ছদ্মনাম) বিদেশে গেছেন। পরিচিত মানুষ, ঢাকায় তাঁর নিজস্ব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। চলছেও ভালো। বিদেশযাত্রার তিন দিন আগেও কথা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। কিন্তু একবারও বলেননি, কানাডা যাচ্ছেন। নাই-ই বলতে পারেন। বিদেশযাত্রা তো আর মঙ্গলগ্রহে যাওয়া নয়। ইনবক্স করি—কানাডায় কি বেড়াতে গেলেন? কবে ফিরবেন?

এই তো কিছুদিন পর—সগীরের উত্তর।

দিন পনেরো পর এক মধ্যরাতে সগীর তাঁর ছোট মেয়ের ছবি ফেসবুকে দিয়ে লিখেছেন, ‘টরন্টোর স্কুলে আজ মাইসার প্রথম দিন। বন্ধুরা দোয়া করো।’ মাস খানেক পর মাইসার স্কুলের রিপোর্ট কার্ড ফেসবুকে। সব কটিতে ভালো গ্রেড।

আমরা যা বোঝার বুঝে নিই। সগীর যে সপরিবারে কানাডায় অভিবাসী হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন, তা বুঝতে আমাদের বাকি থাকে না। এসব নিয়ে খুব বেশি কিছু জিজ্ঞাসাও করা যায় না। মনে একটা খটকা শুধু—সগীররা তো দেশেই অনেক ভালো ছিলেন, হঠাৎ কেন বিদেশ গেলেন?

নয়-দশ মাস পরের কথা। বন্ধুদের এক আড্ডায় হঠাৎ দেখি সগীর আহমেদ।

‘আরে, আপনি দেশে?’

‘চলে এলাম।’

‘পরিবার?’

‘টরন্টোতেই। ‘ওরা ওখানে থাকবে, আর আমি যাওয়া-আসা করব। অভিবাসনের কাগজপত্র পাওয়ার জন্য এবার একটু বেশি থাকতে হলো। দেশে ব্যবসা আমি সামলাব, আর কানাডায় সংসার সামলাবে আপনার ভাবি।’

বাংলাদেশ থেকে বিদেশে গিয়ে ওই দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে থেকে যাওয়া নতুন কিছু নয়। চাকরি, পড়াশোনা কিংবা কাজ করতে যাওয়া মানুষের সংখ্যাও কম নয়। তবে এদেশ-ওদেশ মিলিয়ে থাকার একটা নতুন ধারাও কয়েক বছর হলো দেখা যাচ্ছে। উন্নত জীবনযাপন করা যায় এমন কয়েকটি দেশকে ‘সেকেন্ড হোম’ বানাচ্ছেন অনেকেই। পরিবার বিদেশে, নিজে দেশে ব্যবসা বা অন্য কাজকর্ম দেখবেন, আর আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকবেন। এমন বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, মূলত সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাঁরা সবাই দেশে যথেষ্ট সচ্ছল ও সামাজিক সম্মান নিয়ে বাস করেন।

তারপরও অনেকেই উন্নত সুবিধার জন্য ‘সেকেন্ড হোম’ রাখেন। একেবারে অভিবাসী হয়ে যাওয়া নয়। পরিবারের কর্তা হয়তো পারমানেন্ট রেসিডেন্সি নিয়ে এ দেশে ফিরে আসেন, বাকিরা পুরো নাগরিকত্বই নিয়ে নেন। এ ক্ষেত্রে বেশি পছন্দের দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও মালয়েশিয়া। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সৌদি আরবও রয়েছে। মালয়েশিয়ার সরকারি ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, গত এক দশকে মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম’ সুবিধা নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের অবস্থান ২ নম্বরে। চীনারা এই তালিকার শীর্ষে।

১৮ ডিসেম্বর ছিল বিশ্ব অভিবাসী দিবস। অভিবাসী, প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে যথেষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া যায়। কিন্তু আসা-যাওয়ার অভিবাসীদের নিয়ে তেমন কোনো পরিসংখ্যান নেই। প্রবাসী অধিকার কল্যাণ সমিতি—ওয়ারবে ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক বললেন, ‘এ ধরনের অভিবাসীর সংখ্যা কম। অনেকে দেশে হোটেল বা তৈরি পোশাক কারখানায় বিনিয়োগ করেন, ওদিকে একটা সেকেন্ড হোম রেখে দেন। অনেক সময় দেখা যায়, এই যাওয়া-আসার কারণে জমিজমা বেদখল হয়ে যায়। কারখানা বা ব্যবসা চালাতেও সমস্যা হয়। তবে দেশের চেয়ে বেশি নিরাপত্তা ও সার্বিক উন্নতির জন্যই অনেকে সেকেন্ড হোমের কথা ভাবেন।’

উচ্চবিত্ত, যাঁদের প্রচুর টাকা ও সম্পদ আছে, তাঁদের মধ্যে এই প্রবণতা এখন দেখা যাচ্ছে—এমনটা মনে করেন সমাজবিজ্ঞানী মাহবুবা নাসরীন। তিনি বললেন, ‘অনেকের সন্তান জন্ম নিচ্ছে বিদেশে। কোনো কোনো দেশে জন্মালে সে দেশের নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। এই সুবিধাটা অনেকে নেন।’ তবে এই যে পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে দুই দেশে থাকা, তাতে সন্তানদের সামাজিকীকরণটা জটিল হয়ে পড়ে। ‘অনেক সময় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও তৈরি হয় মানসিক-শারীরিক দূরত্ব। সম্পর্কের মধ্যে সন্দেহ দানা বাঁধে বেশ জোরেশোরেই।’

একজন পেশাজীবী নারীর কথা বলি। তিনি ভালো চাকরি করেন। স্বামী করতেন সরকারি চাকরি। প্রায় তিন বছরের চেষ্টায় পশ্চিমের একটি দেশে অভিবাসিত হয়ে তাঁরা পাড়ি জমালেন। সঙ্গে দুই কিশোর সন্তান। স্বামী চাকরি ছেড়ে দিলেন, স্ত্রী ছুটি নিলেন। এক বছর পর স্ত্রী ফিরে এলেন। ছয় মাস পর আবার গিয়ে কয়েক মাস কাটিয়ে এলেন ‘কাগজপত্র’ ঠিক রাখার জন্য। এই পেশাজীবীর অভিজ্ঞতা, শিক্ষা সনদ ওই দেশে কোনো কাজেই আ​েসনি। তাঁকে গৃহীণী হয়েই সময় কাটাতে হয়েছে।

এই নারীর কথায়, বাচ্চারা গ্লোবাল হবে। নিজের যোগ্যতায় প্রতিষ্ঠিত হবে। এসবই ছিল কারণ। ১৬ কোটি মানুষের দেশে উচ্চশিক্ষা, যথাযথ পেশাজীবন পাওয়া খুব কঠিন। এদিক দিয়ে এখন তাঁরা নিশ্চিন্ত। আবার ওসব দেশে চিকিৎসার ভার সরকারের। বুড়ো বয়সে সেরা চিকিৎসাসেবা পাওয়া যাবে—এটাও থাকে অনেকের মাথায়।

এই পেশাজীবী নারী বললেন, ‘দুই সংস্কৃতি নিয়ে একটু ঝামেলা হয়। ছেলেমেয়ে বিশ্বসংস্কৃতির মধ্যে মিশে যায়। যেমন এখন আমার সন্তানেরা ধীরে ধীরে আমাকে ওদের মতো করে শিখিয়ে পড়িয়ে নিচ্ছে। কিন্তু আমরা এই বয়সে এসে আর ওই সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যেতে পারি না। আমরা এই দেশের সংস্কৃতিকেই ধারণ করে যাই।’

ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে একটা চিন্তা হলো, ছেলে বা মেয়ে বাইরে থাকবে, পড়াশোনা করবে, ফিরে এসে ব্যবসার হাল ধরবে। এ ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা যায় তখন, যখন সন্তান বিদেশি সংস্কৃতিতে বড় হয়ে দেশে এসে খাপ খাওয়াতে পারে না। পারে না এ দেশকে বাবা বা মায়ের মতো করে বুঝতে। বাবার ব্যবসাটাকেও বুঝতে পারে না। নিজের মতে চালাতে গিয়ে ব্যবসার ক্ষতিও হয়।

অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে দীর্ঘদিন বসবাস করছেন কাউসার খান। তিনি একজন অভিবাসী আইনজীবী। বললেন, ‘এই সেকেন্ড হোম যাঁরা করেন, তাঁরা সবাই দেশে সফল। ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, সফল পেশাজীবী, চাকুরে এমনকি খেলোয়াড়েরাও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে সেকেন্ড হোম রাখতে চান। অনেকেই বলেন, ‘আমাদের জীবন তো শেষ প্রান্তে। ছেলেমেয়েরা একটা উন্নত দেশের নাগরিক হোক।’

কাউসারের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন, দেশে যখন ক্ষমতার পালাবদল ঘটে বা অস্থির সময় ঘটে, তখন এ রকম অভিবাসনের ঘটনা বেশি দেখা যায়। দেশে যখন স্থিতিশীলতা থাকে তখন এ হার কম।’

সবকিছুর পর এই ব্যাপারটা দুই নৌকায় পা দিয়ে চলার মতো বলেই মনে করেন অনেকে। বিশেষ করে পরিবারের বাবা কিংবা মা, যিনি আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকেন, তিনি ব্যবসা বা চাকরিটা আর ঠিকমতো করতে পারেন না। পরিবারের সবার একসঙ্গে থাকার যে বিষয়, সেটাও ঠিকমতো হয়ে ওঠে না। শেষ পর্যন্ত বিষয়টাকে সন্তানদের জন্য ‘স্যাক্রিফাইস’ হিসেবেই দেখতে হয়। তারপরও অনেকে বাধ্য হয়ে, অনেকে সন্তানের ভবিষ্যৎ, নিজের নিরাপদ অবসর জীবনের কথা ভেবে সেকেন্ড হোম বানান। কবিতার সেই দুই লাইনের মতো, ‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস/ ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস’।