বিপর্যস্ত ঋতুচক্র

ভিন্ন ভিন্ন কোণ থেকে পৃথিবী
ভিন্ন ভিন্ন কোণ থেকে পৃথিবী

ঋতুচক্র কেন এবং কীভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে, সে সম্পর্কে আলোচনার আগে ঋতুচক্র কী, সেই প্রসঙ্গে কিছু কথা শুরুতেই বলে নেওয়া যাক। ঋতু হলো, একটি বর্ষের মধ্যে জ্যোতির্বিদ্যার (অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল) নিয়মপদ্ধতিতে সময়ের কয়েকটি সুনির্দিষ্ট বিভাজন। আর ঋতুচক্র হলো, আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে আপন আপন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে চক্রাকারে বারংবার সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে একই সময়ে ঋতুদের আবর্তন প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা। এদের বিভাজন তৈরি হয়েছে পৃথিবীর আবহাওয়ার ভিত্তিতে। এটা হয়েছে ইকোলজি পদ্ধতির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যগুলো কী ভাবে প্রভাব ফেলে নিজ নিজ প্রকৃতিতে বিশিষ্ট হয়ে ওঠে, সেটা সুদীর্ঘকাল পর্যবেক্ষণ করার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে।
বিশ্বের সব দেশেই ঋতুর সংখ্যা অবশ্য সমান নয়। পৃথিবীপৃষ্ঠে তাদের অবস্থানের ওপর নির্ভর করে এবং স্থানীয় পরিবেশের ভিন্নতার কারণে কোথাও বছরে একটা, দুটো অথবা তিনটি ঋতুর অস্তিত্ব ধরা পড়ে। কোথাও আবার ঋতুর সংখ্যা চার কিংবা ছয়। যেমন উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকাসহ অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ইংল্যান্ড, রাশিয়া ও জার্মানি প্রভৃতি দেশে চারটি ঋতু দৃশ্যমান। এশিয়া মহাদেশের অনেক অঞ্চলেও এই চার ঋতুই দৃশ্যমান প্রকৃতিতে। যেমন জাপান, চীন, কোরিয়া, ভারতের বেশিরভাগ অঞ্চল। অতি শুষ্ক অথবা মরুভূমির দেশে ঋতু শুধুমাত্র দুটি। গ্রীষ্ম আর বর্ষা। আবার দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সাগর দ্বীপের রাষ্ট্র ফিলিপাইনেও দুটি ঋতুই দৃশ্যযোগ্য। তবে পরিবেশবিদরা মৃদু তাপমাত্রার কয়েকটি অঞ্চলকে (যেখানে সারা বছরে তাপমাত্রার তারতাম্য চরমভাবে অনুভবযোগ্য নয়) ছয় ঋতুর মডেল হিসেবে উল্লেখ করলেও সুস্পষ্ট পার্থক্যে ষড়ঋতুর উপস্থিতি কেবল বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলার কিছু অংশ ছাড়া অন্য কোথাও সেভাবে উল্লেখযোগ্যভাবে অস্তিত্ব ঘোষণা করে না। এই ষড় ঋতু হলো, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত আর বসন্ত।

ঋতুচক্রের আবর্তনক্রিয়া মহাবিশ্বের অন্য কোনো গ্রহে অস্তিত্বমান রয়েছে বলে এখনো পর্যন্ত জানা যায়নি। বিশ্বে আবিষ্কৃত গ্রহগুলোর মধ্যে এখনো অবধি বসুন্ধরা পৃথিবীই একমাত্র প্লানেট, যেখানে জলবায়ু ও আবহাওয়ার ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র প্রকৃতি থাকায় সব ধরনের জীবের অস্তিত্বই সুস্থিরভাবে টিকে থাকার পক্ষে অনুকূল পরিবেশ বিরাজমান। সোলার সিস্টেমে পৃথিবী সূর্যের তৃতীয় নিকটতম প্রতিবেশি। অন্যসব গ্রহগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র বসুন্ধরার পরিবেশমন্ডলের বৈশিষ্ট্যগুলো ( Climatic featurers) যেমন বছরের বিভিন্ন সময়ে তাপমাত্রার ভিন্নতা, বাতাসের চাপ, বায়ুপ্রবাহ, বাতাসের আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত, মেঘাচ্ছন্নতা ইত্যাদি সবচাইতে বেশি স্পষ্ট। ভূপৃষ্ঠে ভৌগলিক অবস্থানের বিশেষত্ব ও পরিবেশমন্ডলের সুনির্দিষ্ট কারণে পৃথিবীকে তার কেন্দ্রস্থান থেকে প্রধানত উত্তর ও দক্ষিণ এই দুই গোলার্ধে বিভক্ত করা হয়েছে। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে এদের ঋতুপরিক্রমা আর ঋতুপর্যায়গুলোর মধ্যে যে ব্যবধান দেখা যায়, তাতে দুই গোলার্ধেই নিজস্ব বৈশিষ্টে্য পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে একই সময়ে একই ঋতু আবর্তিতও হয় না। উত্তর মেরুতে যখন শীতের শুরু, দক্ষিণ মেরুতে সেই সময়ে গ্রীষ্মের আরম্ভ। এই যে দুই মেরুতে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঋতুর আবর্তনক্রিয়ার কার্যকারণ সম্পর্ক, সেটা পৃথিবী গ্রহের সূর্যকে প্রদক্ষিণের অবস্থানের ওপর নির্ভরশীল। দুই গোলার্ধে ঋতুচক্রের প্রকাশ কিংবা তাদের চক্রাকারে অন্তরাল হয়ে যাওয়াও সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর চক্রাকারে পরিভ্রমণের ওপর নির্ভর করে সংঘটিত।
৩৬৫ দিনের চেয়ে সামান্য একটু বেশি সময় নিয়ে নিজ অক্ষপথে বসে সূর্যের চারদিকে পৃথিবী বছরে একবার যখন প্রদক্ষিণক্রিয়া সমাপ্ত করে, তখন পরিক্রমণের মুহূর্তে বছরের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সূর্যের আলো ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় ভূপৃষ্ঠে পতিত হয়ে সৃষ্টি করে ঋতুচক্র। কারণ পৃথিবী সূর্যের চারপাশে কখনোই খাড়াখাড়িভাবে নয়, সামান্য হেলে থেকে পরিভ্রমণ করায় সৌররশ্মি পৃথিবী পৃষ্ঠে সরাসরিভাবে পতিত হয় না। নিজের অক্ষপথে বসে সূর্যের চারপাশে সামান্য হেলে থেকে পৃথিবীর যে পরিক্রমা হয় সেটাও সর্বদা একই ডিগ্রীতে স্থায়ী হয় না। এর পরিমাপ ২৩.৫ ডিগ্রী থেকে ২২.৫ ডিগ্রীর মধ্যে ওঠা নামা করে। অর্থাৎ বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সত্য হলো বসুন্ধরায় সুনির্দিষ্ট নিয়মে বছর জুড়ে ঋতুচক্রের যে আবর্তন ঘটে, সেটা পৃথিবীপৃষ্ঠে সূর্যের আলোকরশ্মি বিকিরণের ওপর কেবল নির্ভরশীল নয়। পৃথিবী সারা বছর ধরে কোন কোণে (এঙ্গেল) থেকে ভূপৃষ্ঠের কোনস্থানে কখন কতটুকু সৌররশ্মির উত্তাপ গ্রহণ করছে, তার ওপর নির্ভর করেই ঋতুচক্র প্রকৃতিতে প্রভাব ফেলে পরিদৃশ্যমান হয়ে ওঠে। সে কারণেই পৃথিবীর সর্বত্র ঋতুর সংখ্যা সমান নয়। এবার এখানে এসে যে প্রশ্নটা দেখা দিয়েছে সেটা হলো, দীর্ঘকালের সুনির্দিষ্ট ঋতুপরিক্রমায় যে নাটকীয় রদবদল কয়েক দশক ধরে সূচিত হয়েছে তার পেছনের কারণ কি সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর পরিভ্রমণের নিয়মে কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য ভাঙন ধরার ফলে? পৃথিবীর অক্ষপথ কি পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে বিপর্যস্ত জলবায়ুর প্রভাবে? যে কারণে ঋতুকুলের চরিত্র প্রকৃতিতে সব নিয়মবিরুদ্ধ পরিস্থিতি ক্রমেই লক্ষযোগ্য হয়ে উঠছে? এবং যার প্রভাবে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে বিশ্বের জীবজগৎ ও উদ্ভিদজগৎ ঘিরে।
পৃথিবী তার অক্ষপথে বসে ভ্রমণের পরিচিত নিয়ম পরিবর্তন করছে এমন সন্দেহ ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে উদিত ও অস্তাচল সূর্যের অবস্থান নির্ণয়ের সমীকরণ থেকে। উত্তর কিংবা দক্ষিণ গোলার্ধে সাধারণত সূর্যের উদয় আর অস্তাচল দীর্ঘকাল যে অবস্থান থেকে হতো তার পজিশন নাকি বদলে গেছে অনেকটাই। পৃথিবীর দুই বিপরীত মেরুর পরিবেশমন্ডলে তাই ক্রমশ দৃশ্যযোগ্য হয়ে উঠছে নানান রদবদল। বিশ্ব সৃষ্টির পর থেকে ভূপৃষ্ঠের ভৌগলিক চেহারায় রদবদল আর রূপান্তর এর আগে কতবার ঘটে গেছে সেটা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে লক্ষ লক্ষ বছর আগেকার জীবধাত্রী বসুন্ধরার সঙ্গে আজকের পৃথিবীর চেহারাছবির ফারাক যে বিস্তর সে সম্পর্কে বর্তমানে আবিষ্কৃত বহু প্রকার জলবায়ু সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণ উপস্থিত আধুনিক মানব সমাজের কাছে। দক্ষিণ গোলার্ধের অ্যান্টার্কটিক মহাদেশের অ্যান্টার্কটিকা স্বয়ং তার একটি জ্বলন্ত প্রমাণ। অ্যান্টার্কটিকা ১৭০ মিলিয়ন বছর আগে যখন সুপারকন্টিনেন্ট গ্লোয়ানার অংশ ছিল, তখন আজকের মতো ভারী শক্তকঠিন শুকনো বরফের চাদরে স্তরে স্তরে আচ্ছাদিত ছিল না তার দেহ। এমনকি ২৫ মিলিয়ন বছর আগে যখন সে গ্লোয়ানা থেকে বিভক্ত হয়ে আলাদা অসিবতত্ব নিয়ে গঠিত হতে আরম্ভ করে তখনো তার তাপমাত্রা আজকের মতো হিমশীতল ছিল না। উষ্ণ তাপামাত্রায় বনান্তরে বিস্তীর্ণ ছিল অ্যান্টার্কটিকার সব স্থলভূমি। বিচিত্র আকৃতি ও বিবিধ প্রকৃতির অরণ্যচারী প্রাণীদের উপস্থিতিতে অ্যান্টার্কটিকা তখন রীতিমতো প্রাণময়। তারপর ধীরে ধীরে পৃথিবী তার পূর্ব অবস্থান থেকে সরে আসার ফলে অ্যান্টার্কটিকা বঞ্চিত হলো সৌররশ্মির পর্যাপ্ত আলো আর উত্তাপ প্রাপ্তির সৌভাগ্য থেকে। অনিবার্ণ হিমেল স্পর্শে জমে জমে ক্রমশ বরফ হতে হতে জীববিরল ভূমি হয়ে গেল সে।
প্রাকৃতিক নিয়মে ভাঙাগড়ার নিত্যখেলা অনাদিকাল ধরেই চলছে প্রকৃতির নিয়মে। এর মধ্য দিয়েই ইকোসিস্টেম অনবরত ক্রিয়াশীল থেকে এগিয়ে নিচ্ছে সৃষ্টির ধারাকে। পৃথিবীর দৈহিক গঠনে যে চৌম্বক শক্তি (ম্যাগনেটিক পাওয়ার) রয়েছে সেটা গতিশীলভাবে সক্রিয় থেকেই ইকোসিস্টেমের মাধ্যমে সর্বদা জগতের জলবায়ু ও আবহাওয়ার সামঞ্জস্যবিধান বজায় রাখছে। সূর্যের চারিদিকে নিরন্তর ঘুরতে ঘুরতে দক্ষিণ ও উত্তর নামক দুই বিপরীতমুখী ভৌগলিক মেরুর মধ্যে ব্যালান্স করেই ভূপৃষ্ঠে ঋতুচক্রের বিচিত্র খেলা চলছে। আর সুসামঞ্জস্য রক্ষা করেই যথাযথভাবে তৈরি হচ্ছে ক্লাইমেটিক ফিচারগুলোও (বিভিন্ন তাপমাত্রা, বায়ুর চাপ, বৃষ্টিপাত, বাতাসের আর্দ্রতা ইত্যাদি)। জলবায়ু ও আবহাওয়া তৈরিতে সামঞ্জস্যসাধনের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া অতি জটিল আর সুনির্দিষ্ট পন্থায় নানা কার্যকারণ সম্পর্কে জড়িত। শক্তিরূপিনী অভিজ্ঞ প্রকৃতি অনর্থক কখনোই ধ্বংসের খেলায় মত্ত হয় না। নতুন সৃষ্টির কারণে কেবল স্থান থেকে স্থানান্তরে তার ভাঙা গড়ার নিত্যখেলা চলে। তার নিয়মপদ্ধতি সর্বত্রই নিখঁুত। অভ্রান্ত। তার বিধিবদ্ধ নিয়মের মধ্যে কারুর অযাচিত অনভিজ্ঞ হস্তক্ষেপ তাই সহ্য করতে পারে না প্রকৃতি। প্রকৃতির সেই অতি সূক্ষ্ম নিয়ম পদ্ধতি আজ বিপর্যস্ত হয়ে যাচ্ছে আধুনিক মানুষের অজসÊ অপরিণামদর্শী কর্মকান্ডের কারণে। সর্বত্র অতিমাত্রার হস্তক্ষেপ জলবায়ুতে ঘনিয়ে তুলছে অবাঞ্ছিত বিপর্যয়। মানবজাতির কর্মকান্ড বৈশ্বিক উষ্ণতার চরম বৃদ্ধি ঘটিয়ে গ্লোবাল ক্লাইমেটকে বিপজ্জনক পরিস্থিতির ভেতরে ঠেলে দিচ্ছে দ্রুতগতিতে।
জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বলছেন, হিউম্যান অ্যাক্টিভিটি ইজ কজিং আওয়ার ক্লাইমেট টু চেঞ্জ। পৃথিবীর অ্যাটমোসফিয়ারে অতি দ্রুত তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বৈশ্বিক পর্যায়ে যে চরম বিপর্যয় সৃষ্টি হয়ে চলেছে তার পঁচানব্বই ভাগেরই দায়, জগতে মানব সৃষ্ট অপরিণামদর্শী কর্মযজ্ঞের জন্য। প্রতিদিন অতিমাত্রায় নির্গত গ্রীনহাউস গ্যাস উত্তপ্ত করে তুলছে পৃথিবীর পরিবেশমন্ডল। বায়ুমন্ডলে গ্রীনহাউস গ্যাস দ্রুত অতি বৃদ্ধির প্রধান কারণ মাত্রাতিরিক্ত অরণ্য ও বনাঞ্চল ধ্বংস করে ফেলা। উন্নত ও অনুন্নত, উভয় বিশ্বেই অতিমাত্রায় গাড়ি চালনা। নিত্যনতুন গজিয়ে ওঠা শিল্পকারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বিশ্বব্যাপী হাজার হাজার বিমান ব্যাপক ব্যবহারের ফলে বিপুল পরিমাণ ফসিল গ্যাস বায়ুমন্ডল ছড়িয়ে পড়ায়। এর স্পর্শে বিশ্বের বায়ুমন্ডল উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হতে হতে বদলে দিচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্যতা। জীবধারিণী পৃথিবী সূর্যের চারদিকে বিশেষ কৌশলে ঘুরতে ঘুরতে ভূপৃষ্ঠ জুড়ে সৌররশ্মি ও তার উত্তাপ ছড়িয়ে দেয় অবিরাম। কেননা সূর্যই জগতে সমস্ত শক্তির আধার। এর থেকে আলো আর উত্তাপ পৃথিবী নিয়মিত না পেলে প্রাণহীন বরফে পরিণত হবে বসুন্ধরা। কিন্তু নিত্যদিন সূর্যমুখী পৃথিবী সূর্য থেকে প্রাণরশ্মি গ্রহণ করলেও সোলার রেডিয়েশনের ভয়ংকর ক্ষতিকারকতা থেকে নিজের সারফেসকে নিরন্তর সে রক্ষা করে পাঁচ স্তরের গ্যাসীয় আবরণ দ্বারা। এরা হলো পৃথিবীর নিকটতম সারফেস থেকে ক্রমান্বয়ে (১) ট্রপোসফিয়ার, (২) স্ট্র্যাটোসফিয়ার, (৩) মেসোসফিয়ার, (৪) থারমোসফিয়ার ও (৫) এক্সসফিয়ার। ট্রপোসফিয়ার স্তর সর্বনিম্ন। সবচাইতে পুরু লেয়ারের গ্যাসীয় আবরণ দিয়ে আবৃত। স্ট্র্যাটোসফিয়ার প্রথমটির চেয়ে পাতলা গ্যাসীয় স্তর। গ্যাসীয় লেয়ারের এই আবরণগুলো ক্রমান্বয়ে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হয়ে সূক্ষ্মতম হতে হতে মিলিয়ে গেছে মহাশূন্যে।
বিমানগুলো সাধারণত স্ট্র্যাটোসফিয়ার স্তরে চলাচল করায় বিমানের নির্গত গ্যাস থেকে তৈরি হচ্ছে স্ট্র্যাটোসফেরিক মেঘ। এই মেঘ উল্লেখযোগ্য হারে ধ্বংস করছে পৃথিবীর ওজোন স্তরকে। উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু সর্বত্রই প্রাকৃতিক পরিস্থিতি আজ হুমকির সম্মুখীন তাই। অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ক্লাইমেটোলজিষ্টরা জানাচ্ছেন, অ্যান্টার্কটিকার ওজোন স্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তিন গুণ আয়তনের চেয়ে বড় এক বিশাল ছিদ্র দেখা দিয়েছে। যে ছিদ্র দিয়ে সোলার রেডিয়েশন আছড়ে পড়ছে লক্ষ লক্ষ বছরের অপরিবর্তিত, অচল অটল শক্তকঠিন হিমশীতল গ্লোসিয়ারের গভীরতা জুড়ে। যে অঞ্চলে বিশ্বের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা সারা বছর ধরে বিরাজমান, এই উষ্ণতার প্রভাব এড়াতে সেই অঞ্চলও ব্যর্থ এখন। দক্ষিণ গোলার্ধের গ্লোাসিয়ার গলতে আরম্ভ করা মানেই গ্লোবাল ক্লাইমেটের বিপুল বিপর্যয়। উত্তর গোলার্ধে আর্কটিক ওসেনের প্রকৃতিগত কারণে তুলনামূলকভাবে ওজোন স্তরে ক্ষয়িষ্ণুতা কম। কারণ উত্তর মেরুতে স্থলভূমি বেশি থাকার জন্য এখানে তাপমাত্রা অনেক বেশি। আর্কটিক সাগরের বরফ, চারপাশে সাগর মহাসাগর পরিবৃত অ্যান্টার্কটিকার মতো শক্তকঠিন অটল এবং অতি পুরু নয়। গ্রীষ্ম ঋতুতে বরফ এখানে গলে যায়। তেমনি স্থলভাগ জলভাগের চেয়ে তাপ দ্রুত ছড়ানোর কারণে দক্ষিণ গোলার্ধের মতো অতি নিম্ন তাপমাত্রা শীত ঋতুতেও এই মেরুতে থাকে না। যার ফলে সমুদ্রে জলীয়বাষ্প সৃষ্টি হয় এবং স্ট্র্যাটোসফেরিক মেঘ ধ্বংস করে তুলনামূলকভাবে ওজোন স্তরের ক্ষয়িষ্ণুতা কমায়। কিন্তু তার পরেও পরিবেশবিদদের সতর্ক উচ্চারণ হলো, এখানকার ওজোন স্তরও ক্রমে পাতলা হয়ে চলেছে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে।
জীবপালিনী পৃথিবীর জলবায়ু বদলে যাচ্ছে চরমভাবে। প্রকৃতি অসহায়। তার ঋতুচক্রের মনোহর রূপ বিপর্যস্ত বারবার। লোভাতুর মানুষ, অনভিজ্ঞ মানুষ আবিষ্কারের নেশায়, ভোগের নেশায়, জয়ের নেশায়, জানার নেশায় জেনে না জেনে, বুঝে না বুঝে বারংবার চূর্ণ করছে তার বিধিবদ্ধ আইন। সে আইন এমনই যা কিনা কড়ায় গন্ডায় হিসেব কষেই তৈরি হয়েছে অভ্রান্ত ও নিখঁুত নিয়মে। কিন্তু তার সমীকরণ এখনো অগম্য আর জটিল রয়ে গেছে জিজ্ঞাসু মানবের চিন্তা ও মননে। যারা ঋতুচক্রের বিপর্যয় নিয়ে অতি উদ্বিগ্নতায় ভুগছেন তারা তাই প্রশ্ন রেখেছেন, কে জানে প্রকৃতির রাজ্যে অনভিজ্ঞ মানুষের অসহনীয় হস্তক্ষেপের পরিণতি কী বয়ে আনবে জীব আর জগতের ভবিষ্যতকে ঘিরে। বিপর্যস্ত ঋতুচক্রের দিকে তাকিয়ে সেই ভবিষ্যৎ কি এখনই অনুভব করা যায়?

দীপিকা ঘোষ
যুক্তরাষ্ট্র