বিশ্ববিদ্যালয় নয়, কিন্ডারগার্টেন ও স্কুলের র‌্যাঙ্কিং করা জরুরি

আজ আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস। সত্যিকার শিক্ষা আসলে কেমন হওয়া উচিত? সফল মানুষ, উদ্যোক্তা বা শিক্ষকদের অভিমত কী?

ছবি: সাজিদ হোসেন

পড়ে শেখার চেয়ে করে শেখা জরুরি

সুন্দর পিচাই, গুগলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু যেমন বদলে যাচ্ছে, তেমনি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বা পড়ালেখার ধরনটাও নিশ্চয়ই বদলানো উচিত। অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি, ভারতে পাঠ্যবইয়ের পেছনে সময় দেওয়াটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাইরের পৃথিবীতে কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। সেখানে কাজের অভিজ্ঞতার গুরুত্ব বেশি। তাই বিভিন্ন ধরনের কাজ করো। ঝুঁকি নাও। খোঁজো, কোন কাজটা তুমি ভালোবাসো। সেটাই মন লাগিয়ে করো। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধিকাংশ ছাত্র তাদের মেজর ঠিক করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে উঠে। কারণ এর আগে পর্যন্ত তারা তাদের আগ্রহের বিষয়টা অনুসন্ধান করে। একাডেমিক পড়ালেখাও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ততটা নয়, যতটা গুরুত্ব আমরা দিই। জীবন একটা দীর্ঘ যাত্রা। তাই আমি যা করছি, তা উপভোগ করা খুব জরুরি।

এখনকার পড়ালেখায় চাপ খুব বেশি। আমার খুব অবাক লাগে, ক্লাস এইট থেকেই নাকি শিক্ষার্থীরা আইআইটিতে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে। কিন্তু এটা বুঝতে হবে, পড়ে শেখার চেয়ে করে শেখা জরুরি। ব্যর্থতা কোনো বাধা না। অনেকে বলে, ‘তুমি অমুক কলেজে ভর্তি হতে পারোনি, ব্যাস, তোমার জীবন তো এখানেই শেষ।’ এমনটা কখনোই না। আশা আর স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখে সেটা অনুসরণ করতে পারাটাই বড়।

২০১৭ সালে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি) খড়গপুরে এক সমাবর্তনে এ কথা বলেছিলেন তিনি।
জ্যাক মা
ছবি: সংগৃহীত

শিক্ষাকে ভালোবাসতে বাধ্য করবেন না, ভালোবাসার শিক্ষা দিন

জ্যাক মা, আলীবাবার প্রতিষ্ঠাতা

সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে সংস্কার করতে হবে। স্কুল সংস্কার করতে হবে, ক্লাসরুম সংস্কার করতে হবে, নতুনভাবে তৈরি করতে হবে শিক্ষকদের। অতীতে শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতেন। ভবিষ্যতের ক্লাসরুমে শিক্ষক-শিক্ষার্থী একসঙ্গে শিখবেন, একসঙ্গে জ্ঞান অর্জন করবেন। অতীতে শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের চেয়ে বেশি জানতেন। ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীরা অনেক কিছুই শিক্ষকদের চেয়ে বেশি জানবে। অতীতে ক্লাসরুমেই পাওয়া যেত সব প্রশ্নের উত্তর। কিন্তু ভবিষ্যতের ক্লাসরুমে শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে মিলে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে, যা আগে থেকেই তৈরি থাকবে না। অতীতে ক্লাস শুধু ক্লাসরুমেই হতো, ভবিষ্যতের ক্লাসরুম হবে চার দেয়ালের বাইরের এই বাস্তব জগৎ।

চলুন, আমাদের কিছু মেধাবী পিএইচডিধারী শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিন্ডারগার্টেন, প্রাথমিক, মাধ্যমিক স্কুলে স্থানান্তর করি। একজন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীর চেয়ে কিন্ডারগার্টেনপড়ুয়া শিশুর মস্তিষ্ক বেশি উর্বর থাকে। শৈশবের শিক্ষা যতটা মনে গেঁথে যায়, ততটা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া মনে গাঁথে না। আমরা দেখি, বিশ্বের প্রায় সব দেশেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেরার তালিকায় নাম লেখানো নিয়ে খুব গর্ব করে। আমার মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিংয়ের চেয়েও এখন কিন্ডারগার্টেন আর প্রাথমিক স্কুলের র‍্যাঙ্কিং তৈরি ও প্রচার করা বেশি জরুরি। দয়া করে দেশের মেধাবী শিক্ষকদের নতুন মেধা তৈরির প্রথম ধাপে নিয়োজিত করুন, শেষ ধাপে নয়।

পরীক্ষার পদ্ধতিতে বদল আনতে হবে। বদল আনতে হবে মেধার মান নির্ণয়ের পদ্ধতিতে। পড়াশোনা মানেই পরীক্ষা দেওয়া আর ভালো ফলাফল করা নয়। যদি পরীক্ষার ফলাফলই হয় শিক্ষার মান নির্ণায়ক, তাহলে আমি বলব শিক্ষাব্যবস্থা ভুল পথে চলছে। আমি চীনের হাইস্কুলপড়ুয়া অনেককে জিজ্ঞেস করেছি, ভবিষ্যতে তুমি কী করতে চাও। বেশির ভাগের জবাব ছিল ‘আমি ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাই’। এর সামনে তাঁরা আর কিছু ভাবতে পারে না। কারণ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের এই ধারণাই দেয় যে ভালো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মানে ভালো চাকরির নিশ্চয়তা। কিন্তু আমি আমার ২০ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, যত ভালো বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই আসুক না কেন, আমরা আলীবাবাতে একজন তরুণকে সম্পূর্ণ ভেঙে নতুন করে গড়ি, প্রশিক্ষণ দিই। তাই গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মানেই ভালো চাকরির নিশ্চয়তা নয়। ডিগ্রির সনদ মানে শুধুই একটা রসিদ, যেটার টাকা তোমার পরিবার দিয়েছে। আসল ডিগ্রি তখনই অর্জন হয়, যখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পর একজন জীবনযুদ্ধে নামে।

শিক্ষাকে ভালোবাসতে বাধ্য করবেন না। বরং ভালোবাসার শিক্ষা দিন। মন দিয়ে ভালোবাসা শেখান। মানুষই পারে মন থেকে ভালোবাসতে। মগজ দিয়ে ভাবে যন্ত্র, হৃদয় দিয়ে ভাবে মানুষ। আজকের শিশুরা মগজ দিয়ে ভাবতে শিখলে, কাল যন্ত্র এসে তাদের জায়গা নিয়ে নেবে। তাই তাদের হৃদয় থেকে ভাবতে শেখান।

২০১৯ সালের ৩ ডিসেম্বর অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) আয়োজিত ফোরাম ফর ওয়ার্ল্ড এডুকেশনে এ কথা বলেছিলেন তিনি।
ছবি: রয়টার্স

অজ্ঞতা কোনো গুণ নয়

বারাক ওবামা, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট

তথ্য–প্রমাণ–কারণ–যুক্তি–বিজ্ঞানের জ্ঞান...জীবনে এসবের গুরুত্ব আছে। সাধারণত আমরা এগুলোকে মূল্য দিই। কিন্তু তুমি যদি এ সময়ের রাজনৈতিক আলোচনাগুলো শোনো, দেখবে একধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক বিরোধিতার প্রভাব আছে। তোমাদের আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই: রাজনীতি বলো, কিংবা জীবন, অজ্ঞতা কোনো গুণ নয়। তুমি কী বলছ তুমি যদি না জানো, সেটা তোমার ‘স্মার্টনেস’ নয়। রাজনীতির শুদ্ধতা নিয়ে তুমি প্রশ্ন তুলতে পারো না, যদি তোমার অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার না থাকো।
তোমাদের প্রত্যেকের পকেটে মোবাইল ফোন আছে। পৃথিবীর ইতিহাসে তথ্য অনুসন্ধান কখনোই এতটা সহজ ছিল না। অথচ দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তথ্যের এই অবাধ ভান্ডারই যেন আমাদের সত্য থেকে আরও দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। কখনো কখনো তথ্য এতটা অবারিত বলেই আমরা অজ্ঞতাকে স্বাভাবিক ধরে নিচ্ছি। আমরা ধরেই নিচ্ছি অন্তর্জালে যা আছে সব সত্যি। অনলাইনে আমি তা-ই খুঁজি, যা আমার বিশ্বাসকে সমর্থন করে। মানুষের অভিমত এখানে সত্যের ছদ্মবেশে ধরা দেয়। অকাট্য মিথ্যেটাও বেদবাক্য হয়ে যায়।
দেখো, আমি বলছি না ঠান্ডা মাথায় ভাবা এবং লিখিত প্রমাণের চেয়ে আবেগ, বিশ্বাস, ভালোবাসা, আনুগত্য—এসবের গুরুত্ব কম। আমি শুধু বলছি মানুষের এসব গুণ তখনই ঠিকভাবে কাজ করে যখন আমরা পরিষ্কারভাবে ভাবতে শিখি। আর সেটা অর্জন করতে হলে, সবার জন্য ভালো এমন কিছু করতে হলে, আমাদের মাথাকে কাজে লাগাতে হবে। আমাদের মানতে হবে, তথ্য-প্রমাণের গুরুত্ব আছে। যা বলছি, প্রতিটা কথার দায় আমাদের নিতে হবে।

২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রাটগার্স ইউনিভার্সিটিতে এক সমাবর্তন বক্তৃতায় এ কথা বলেছিলেন তিনি।
অমিত চাকমা
ছবি: সংগৃহীত

প্রয়োজন মানবতার শিক্ষা

অমিত চাকমা, উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া

শিক্ষা বলতে আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সনদভিত্তিক শিক্ষাকেই বোঝাতে চাই। প্রকৃত আর সনদভিত্তিক শিক্ষা—দুটিই আমাদের প্রয়োজন। উদাহরণ হিসেবে একজন শল্যবিদ বা সার্জনের কথা ধরা যাক। একজন সার্জনকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রায় এক দশক পড়ালেখা করতে হয়, ক্লিনিক্যাল প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এই দীর্ঘ প্রশিক্ষণ অস্ত্রোপচারের কাজে তাঁকে দক্ষ করে তোলে। যেহেতু সার্জনের ওপর রোগীর জীবন-মৃত্যু নির্ভর করে, দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ সনদের মাধ্যমে তাঁর যোগ্যতার আশ্বাস দেন। কিন্তু তিনি প্রকৃত শিক্ষায় কতটা শিক্ষিত হয়েছেন, সনদ সেই নিশ্চয়তা দিতে পারে না।
ভাষার দক্ষতা, সংখ্যা নিয়ে কাজ করার দক্ষতা, আইডিয়া বা ধারণা প্রকাশ করতে পারার ক্ষমতা মৌলিক শিক্ষার ন্যূনতম উপাদান মাত্র। জ্ঞান অর্জনের জন্য এসব বুনিয়াদি সরঞ্জাম। সত্যিকার শিক্ষিত হওয়ার জন্য এগুলো প্রয়োজনীয়, তবে পর্যাপ্ত নয়। শিক্ষিত মানুষ হওয়ার জন্য এসবের চেয়েও বেশি প্রয়োজন মানবতার শিক্ষা।

আমার খুব প্রিয় একটা প্রবাদ হলো, ‘মন একটা প্যারাসুটের মতো, খোলা থাকলেই ভালো কাজ করে।’ আমরা সবাই মুক্তমন নিয়ে জন্ম নিই। পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পারিপার্শ্বিক কারণে ধীরে ধীরে আমাদের মন পক্ষপাতমূলক ধারণায় বন্দী হতে থাকে। সত্যিকারের শিক্ষা আমাদের এই পক্ষপাতদুষ্ট চিন্তাধারা ভেঙে দিয়ে নির্দ্বিধায় ভাবার ক্ষমতা দেয়।

২০২০ সালের ২১ জুন প্রথম আলোর ক্রোড়পত্র স্বপ্ন নিয়েতে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে এ কথা লিখেছিলেন তিনি।
খান একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা সালমান খান
ছবি: ফেসবুক

শিক্ষাকে স্থান ও কালের সীমাবদ্ধতায় বেঁধে ফেলা যাবে না

সালমান খান, খান একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা

আগামী শিক্ষাবর্ষ আগের মতো হবে কি না আমরা জানি না। স্কুলে ফিরলেও হয়তো সামাজিক দূরত্ব মানতে হবে। শিক্ষার্থীদের আলাদা শিফটে ভাগ করা হতে পারে। যদি সংক্রমণ বেড়ে যায়, তখন আবারও স্কুল বন্ধ করে দিতে হবে। আপনি ধরে নিতে পারেন না যে একটা নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট সময়ে আপনার সব শিক্ষার্থীকে আপনি এক রুমে পাবেন। অতএব আপনাকে সেভাবেই পাঠ্যক্রম তৈরি করতে হবে। কিছু প্রযুক্তির সাহায্য নিতেই হবে। শিক্ষাকে আপনি স্থান ও কালের সীমাবদ্ধতায় বেধে ফেলতে পারবেন না। আমি এমন এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি, যেখানে আপনি স্কুল বা হাইস্কুলে গেছেন কি না, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যেখানে প্রয়োজনীয় জ্ঞান আপনার আছে কি না, তা প্রমাণ করতে পারলেই আপনি চাকরি পাবেন কিংবা উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাবেন।

গত ১৯ মে প্রথম আলোর ফেসবুক পেজে এক লাইভ আড্ডায় এ কথা বলেন খান একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা।