বুঝেশুনে সন্তান মানুষ করছেন তো?

সন্তানের কাছে নানাভাবে প্রকাশ করুন আপনার স্নেহ। এটি তাকে নিরাপত্তাবোধ দেবে। মডেল: সাঁঝবাতি ও বুড়ি আলী। ছবি: অধুনা
সন্তানের কাছে নানাভাবে প্রকাশ করুন আপনার স্নেহ। এটি তাকে নিরাপত্তাবোধ দেবে। মডেল: সাঁঝবাতি ও বুড়ি আলী। ছবি: অধুনা

শিশু বড় হয়ে কেমন মানুষ হবে? তার অনেকখানিই নির্ধারিত হয়ে যায় তার শৈশব ও কৈশোরেই। একটা বয়স পর্যন্ত মা-বাবা বাচ্চাকে অতিরিক্ত আহ্লাদ-আদর দেন। এরপর সন্তান যখন বয়ঃসন্ধির বয়সে পা দেয়, তখন থেকে শুরু হয় সমস্যা। মা-বাবা সন্তানের বয়সের নানা ধাপের সঙ্গে নিজেদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে পারেন না অনেক সময়। মা-বাবার জন্য কিছু কথা—

কর্তৃত্বপরায়ণ সন্তানপালন
বাবা-মা সন্তানদের কঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলে বড় করেন এবং সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি হলেই শাস্তি দেন। এমন ক্ষেত্রে সন্তানেরা বড় হলে মানসিকভাবে হীনম্মন্য বা ভিতু প্রকৃতির হয়।
সন্তানের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করা
এ ক্ষেত্রে সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের মানসিক যোগাযোগ খুবই কম থাকে। শুধু সন্তানের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করা ছাড়া সময় একেবারেই দেন না। ছেলেমেয়েরা বড় হয় একা একা। কোনো রকম যত্ন ছাড়া। এ ধরনের ছেলেমেয়েরা নানাভাবেই বিপথগামী হতে পারে, মূল্যবোধের দৃঢ় ভিত্তি এদের গড়ে ওঠে না।

পারমিসিভ প্যারেন্টিং
এ ক্ষেত্রে সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের দৃঢ় মানসিক যোগাযোগ থাকে। এ ক্ষেত্রে একধরনের সতর্ক দৃষ্টির মাধ্যমে শিশু স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠতে পারে। এতে বাচ্চারা আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে বড় হয়।
সন্তানকে বুঝতে দিন আপনার শর্তহীন ভালোবাসা। সন্তানকে আপনার অবাধ ভালোবাসার উষ্ণতা একধরনের গভীর নিরাপত্তাবোধ দেবে। নিরাপত্তার এই বোধ তাকে পরবর্তী জীবনে সম্পর্ক স্থাপন বা চলার পথে নানা সমস্যা দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে সাহায্য করবে। নানাভাবে প্রকাশ করুন আপনার আদর, স্নেহ।

কোন আচরণে মনোযোগ দেবেন?
মনোবিজ্ঞানের একটা নিয়ম হলো, অন্যের যে আচরণে আমরা মনোযোগ দেব, সে আচরণ আরও উৎসাহ পাবে এবং পুনরায় করবে। এই মনোযোগ সন্তানের আবদার পূরণ বা প্রশংসাসূচক কথা বলার মাধ্যমে যেমন হতে পারে, তিরস্কারের মাধ্যমেও হতে পারে। ফলে সন্তানের যে আচরণ আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য বা কাঙ্ক্ষিত নয়, সেটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করুন। আপনার ক্রমাগত উপেক্ষা তার অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ কমিয়ে আনবে।
তবে আচরণ যদি অতিরিক্ত অগ্রহণযোগ্য হয় (যেমন বেয়াদবি করা, কথা একেবারেই না শোনা, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করা) ইত্যাদির ক্ষেত্রে শাস্তির বদলে তার প্রাপ্য সুবিধা (যেমন আদর করা, যত্ন করা, কথা বলা, উপহার দেওয়া) ইত্যাদি সাময়িকভাবে কমিয়ে দিন।

কাঙ্ক্ষিত আচরণ
সন্তান যখন কাঙ্ক্ষিত আচরণ বা ভালো কাজ করবে, সেটা যত সামান্যই হোক, সেটাতে সঙ্গে সঙ্গে মনোযোগ দিন (যেমন প্রশংসা করা, আদর বাড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি)। আপনার সামান্য প্রশংসা তার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেবে। ভালো আচরণগুলো আরও বেশি বেশি করার উৎসাহ পাবে।

আচরণের সামঞ্জস্য
সন্তানের সামান্য যেকোনো বিষয়ের বাবা-মায়ের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ একই রকম থাকবে। শুধু তা-ই নয়। এমন প্রতিশ্রুতি কখনো সন্তানকে দেবেন না, যা আপনি রাখতে পারবেন না। যেকোনো অসামঞ্জস্যতায় সন্তান বিভ্রান্তির মধ্যে বড় হয়। ঠিক-বেঠিকের ধারণা তার সঠিকভাবে হয় না। নৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তি হয় দুর্বল, যা ভবিষ্যতে নেতিবাচক প্রভাব পরিবার ও সমাজে সুদূরপ্রসারী।

কোনো কিছুতেই জবরদস্তি নয়
‘চাপ’ দিয়ে কোনো কিছু সাময়িকভাবে আদায় করা গেলেও সেটা মূলত দীর্ঘস্থায়ী হয় না। বরং সেটার প্রতি একধরনের বিরক্তিভাব তৈরি হয়। শিশুদের ক্ষেত্রেও এমনটা হয়। অনেক ক্ষেত্রে অতিরিক্ত জবরদস্তির জন্য ধীরে ধীরে যেমন বাচ্চাদের পড়ালেখার আগ্রহ কমে যেতে পারে, তেমনি চাপাচাপির কারণে শিশুদের খাওয়ার আনন্দও নষ্ট হয়ে যায়। শিশুকালে পড়াশোনায় ভালো ফলাফল করার চেয়ে বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করার জন্য সুযোগ দিন।

খেলাধুলা
যেসব খেলায় শারীরিক পরিশ্রম, সেসব খেলা শুধু শরীরের জন্যই জরুরি নয়, মানসিক বিকাশের জন্যও প্রয়োজন। খেলার মাধ্যমে একজন শিশু আরেকজন শিশুর মানসিক গঠনের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে। বন্ধুত্ব ও সামাজিকভাবে মেলামেশার দক্ষতা তৈরি হয়। খেলার মাধ্যমে ছোটখাটো ঝগড়া-বিবাদ বা ঝামেলা সামলানো শেখে। এ অভিজ্ঞতা তার ভবিষ্যৎ জীবনের নানা সমস্যা মোকাবিলা করতেও সাহায্য করবে।

মোবাইল বা কম্পিউটার গেমে নিরুৎসাহিত করা
মোবাইল বা কম্পিউটার গেমে একধরনের আসক্তির উপাদান থাকে। এসবে অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা শিশুকে চারপাশের সামাজিক জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখে। তবে একেবারে নিরুৎসাহী না করতে চাইলে কম্পিউটার বা মোবাইল ব্যবহারে সময় বেঁধে দিন।

সমালোচনা নয়
কঠিন তিরস্কার, সমালোচনা করা কিংবা অন্য শিশুদের সঙ্গে তুলনা করা ইত্যাদি তাদের আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয়। বেড়ে ওঠার সময় শিশুর নিজের প্রতি ধারণা অনেকখানি তৈরি হয় বাবা-মা তাকে কীভাবে দেখছেন, তার ওপর। সুতরাং কোনো কাজ অপছন্দ হলে কঠোর সমালোচনা না করে অল্প কথায় আপনার অপছন্দ স্পষ্ট করে জানান।

ব্যর্থতা মেনে নিতে শেখান
একটা কথা মনে রাখতে হবে, আপনার অসীম নিরাপত্তার ছায়ায় আস্তে আস্তে বড় হওয়া আদরের সন্তানটিকে বড় হওয়ার পর অবশ্যম্ভাবীভাবেই জীবনের নানা জটিল পথ পার হতে হবে। সফলতার সঙ্গে সঙ্গে নানা ব্যর্থতাও তার জীবনে আসবে। শিশুর বর্তমানের ছোটখাটো ব্যর্থতা স্বাভাবিকভাবে নিন এবং তাকে সহজভাবে মেনে নিতে শেখান। এ ছাড়া শিশুর চাহিদার সবটাই সব সময় পূরণ করার প্রয়োজন নেই। জীবনে আমরা যা চাই, যেভাবে চাই তার কিছু ঘটবে, কিছু ঘটবে না—এই সত্য, এই বোধ সে আপনার কাছ থেকেই একটু একটু করে জানবে।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ

সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা