বৃত্ত ভাঙার খেলা

আমি যখন এসএসসি পরীক্ষা দিই তখন স্কুলের মিলাদে যাব, মানে বিদায় সংবর্ধনা। ছোট ভাইটি ছিল আমার খুবই নেওটা। সারাক্ষণ আমার সঙ্গে থাকতে চাইত। তাই তাকে নিয়ে যাব ঠিক করলাম। মেজো ভাইটি অতিরিক্ত রাগী কিন্তু তার ভালোবাসা বেশি। সে–ও সঙ্গে যাবে বলে বায়না ধরল। আমি কোনোভাবেই তাকে নেব না। ছোট ভাই (পাভেল) কোনো বুদ্ধি বের করতে পারল না রুহেলকে (মেজো ভাই) কীভাবে বাদ দিয়ে মিলাদে যাওয়া যায়। তবুও যথারীতি আমি পাভেলকে নিয়ে রওনা দিলাম, রুহেলও কাপড় পরে আমাদের সঙ্গে রওনা দিল। আমার স্কুল বাসা থেকে বেশ দূরে ছিল, বাসে যেতে হতো। যতই চেষ্টা করি রুহেল ফেরত যাবে না, আমি আর পাভেল বাসে চড়লাম, রুহেলও উঠে পড়ল। যেই বাস ছাড়ল, আমি একটু ধাক্কা দিয়ে রুহেলকে বাস থেকে নামিয়ে দিলাম। দেখলাম সে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছে! আমল দিলাম না, বয়সটাই অমন ছিল। 

আমি আর পাভেল স্কুলের মিলাদ শেষ করে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে বাসায় ফিরলাম। দেখি রুহেল তখনো কাঁদছে! অনেক সাধাসাধিতেও সে মিষ্টি খেলো না। এসএসসি পাস করলাম, কলেজে গেলাম। একটু একটু বুদ্ধি-বিবেক বাড়তে লাগল। হঠাৎ কবে তা বলতে পারব না, কিন্তু রুহেলের জন্য আমার তীব্র কষ্ট লাগা শুরু হলো। সেই বাস থেকে নামিয়ে দেওয়ার ঘটনার জন্য আমি আজও কষ্ট পাই। চোখের পানি ফেলি কিন্তু রুহেল জানে না।
যখন আমাদের পরিবারের কর্তা আমার বাবা ছিলেন, ঘটনাটি তখনকার। বাবার বৃত্ত ভেঙে আমার নিজের যে একটি বৃত্ত হবে সে রকম মানসিক প্রস্তুতি আমার কোনো কালেই ছিল না, এখনো নেই। কিন্তু তাতে কী? সময় ঠিকই আমি ও আমার অন্য দুই ভাইয়ের বৃত্ত বানিয়ে দিয়েছে। ছোট দুই ভাইও বিয়ে করেছে, তাদের নিজেদের সন্তান হয়েছে। সময় বয়ে চলেছে সময়ের মতো। এভাবেই বৃত্ত তৈরি হয়, আবার ভাঙা হয় প্রকৃতির নিয়মে। আমিও একসময় বুড়ো হব, আমার অন্য ভাইবোনেরাও বুড়ো হবে। তাদের ছেলেমেয়েরাও বড় হবে, নিজেদের বৃত্ত তৈরি করবে। এই বৃত্ত ভাঙা-গড়ার খেলায় কিছু মানুষ যে আটকে যায়, কষ্টে তাদের বুক চৌচির হয়ে যায়, বাবার বৃত্ত থেকেই যাদের বের হওয়ার ক্ষমতা বা বাসনা লোপ পায়, সেই মানুষগুলোর খবর রাখে কজন? খবর রাখার সময়ই তো আসলে কারও নেই, সবাই যুদ্ধ করছে নিজের জন্য, নিজের মতো।
প্রকৃতির নিয়ম মেনে বিয়ে করলাম, ছোট ভাইবোনদেরও একসময় নিজের সংসার হলো। বিদেশে থাকি, একসময় বউ এল। আমার মনে আছে, বাবা সব সময় দুপুরে একসঙ্গে সবাই মিলে খাওয়াটা রেওয়াজে পরিণত করেছিলেন। কেউ আগে খেয়ে ফেললে খুব রাগ করতেন! আজ বাবা নেই, রাগ করার মানুষও নেই! যদি জানতাম বড় হওয়া মানে ধীরে ধীরে নিজ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা পরিবার তৈরি করা, হতাম না বড়! আসলেই না... কোনো না কোনোভাবে বড় হওয়া ঠেকিয়ে রাখতাম। তাই কি আর হয়? এভাবে তো দুনিয়া চলে না! অতি প্রিয়জন মারা গেলেও সবাইকে খাবার খেতে হয়, নিজের কাজে যেতে হয়! পৃথিবী বড় নিষ্ঠুর!

প্রতি ঈদে বাবা সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজে গোসল করে আমাদের সবাইকে ডাকতেন ঈদের নামাজে যাওয়ার জন্য। এত ভোরে বিরক্ত হলেও কারও কিছু করার ছিল না, সবাই পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে আব্বার সঙ্গে ঈদের নামাজে যেতাম। তিনি হজ করার পর থেকে ঈদে সব সময় সৌদি আলখাল্লা পড়তেন, মাথায় পাগড়ি দিতেন, চোখে সুরমা দিতেন। ওই আলখাল্লাই ছিল তার মতো সাধারণ মানুষের চমক। আমরা প্রথম দিকে খুব লজ্জা পেতাম, পরে গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। ওই অদ্ভুত পোশাক দেখে সবাই একবার হলেও আব্বার দিকে তাকাত, এটাই ছিল তাঁর আনন্দ। সাধারণ মানুষ কত অল্পতে আনন্দিত হতে পারে, আমার বাবা ছিল তার উজ্জ্বল উদাহরণ। এই অতি সাধারণ বাবাটি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ২০০৯ সালে। সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন আমাদের ঈদ আনন্দ। বিদেশে থাকি, বাবা চলে যাওয়ার পর কখনো ঈদে দেশে যাই না, কীভাবে যাই? কলিজাটা যে ছিঁড়ে যায় আমাদের। একজন মানুষ মারা যাওয়ায় যে গোটা পরিবারের ঈদ আনন্দ মাটি হয়ে যায় চিরদিনের জন্য, সেটি দেখতে চাইলে কেউ ঈদে আমাদের বাসায় এসে দেখতে পারেন।

বাস্তবতা হয়তো আমাকে বিচ্ছিন্ন করেছে, অদৃষ্ট আমাকে আলাদা থাকতে বাধ্য করেছে জীবনের প্রয়োজনে। সৃষ্টিকর্তা সাক্ষী, আমি কখনো বাবার বৃত্ত থেকে বের হতে চাইনি। এখনো চাই না।