
রূপকের ঘরটা দেখে আমার মন ভালো হয়ে যায়। দেয়ালে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আর জীবনানন্দের পেইন্টিং। পড়ার টেবিলের পাশে সিডি প্লেয়ার। টেবিলের নিচে সব রবীন্দ্রসংগীতের সিডি। ঠিক তার পাশেই বুকশেলফ। দেশ-বিদেশের বিখ্যাত লেখকদের বই সাজানো। দেয়ালে ৪০ ইঞ্চি এলইডি টিভি। সুন্দর মখমলের চাদর বিছানায়। পর্দাগুলো খুব পরিষ্কার। আমি রূপকের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘বন্ধু, তোমার রুমটা আমার দারুণ পছন্দ হয়েছে!’
কথা শুনে রূপক হাসে। আহ্লাদী দৃষ্টিতে তাকায়। বলে, ‘আজ তো আমাদের বাড়ি প্রথম এসেছ। আর কয়েকবার এলে আমাদের বাসা তোমার আরও ভালো লাগবে।’
‘তাই নাকি? কেন বলো তো?’
রূপকের ভ্রু নাচে। বলে, ‘ভীষণ ইন্টারেস্টিং খবর আছে। পাঁচ বছর ধরে আমাদের বাসায় একজন ভদ্রমহিলা থাকেন। তিনি নাকি অনেককাল আগে হারিয়ে গেছেন। অতীতের কোনো কথাই এখন আর মনে করতে পারেন না। আমার এক মামা তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন। সেই থেকে আমাদের বাসায় উনি আছেন। কাজ বলতে শুধু রান্নাবান্না করেন। মজার মজার খাবার। একবার খেলে সেই স্বাদ তুমি কখনো ভুলতে পারবে না। অসাধারণ! উনিই আজ আমাদের জন্য রান্না করেছেন।’
আমি কথাটা শুনে কী রকম আনমনা হয়ে যাই। বুকের ভেতরটা ঢিপ ঢিপ করে। আমার বয়স যখন পাঁচ, তখনই একটা বড় দুর্ঘটনায় পড়ি আমরা। বাবাই গাড়ি চালাচ্ছিলেন। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম। গাড়ির ভেতরে আমি আর মা। চট্টগ্রাম পার হতেই একটা কালভার্টের কোনায় গাড়িটা লেগে খাদের ভেতরে পড়ে যায়। আমার যখন জ্ঞান ফেরে, তখন শুনি বাবা বেঁচে আছেন। কিন্তু মাকে আর পাওয়া যাচ্ছে না। বহু খুঁজেও মায়ের লাশটা পাওয়া যায়নি। পত্রপত্রিকায় খবর ছাপা হয়েছে। পুলিশও অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু কেউ তাঁর কোনো খবর পায়নি। তবু আমার ধারণা, মা বেঁচে আছেন। কোনো না কোনো দিন মা আবার ফিরে আসবেন। ভদ্রমহিলার কথা শুনে আমি মায়ের মুখটা ভাবি। তাঁর চেহারার সঙ্গে নিজের মাকে মেলাই। বুকের ভেতরটা হু হু করে।
রূপক অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়। অস্ফুট কণ্ঠে বলে, ‘একি, তুমি কাঁদছ কেন?’
খাবার টেবিলে বসে আমি ওই ভদ্রমহিলাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করি। তিনি হাসিমুখে তাকিয়ে আছেন। আমি ব্যস্ত হয়ে মাকে খুঁজতে থাকি। মায়ের ঠোঁটের নিচের কালো তিল, কোঁড়ানো চুল। ডান কপালের কালো দাগ। হুবহু মিল। আমার অস্থির লাগে।
রূপক তাড়া দেয়, ‘কী হলো, তুমি খাচ্ছ না? দেখো, খালা কী সুন্দর সুন্দর খাবার রান্না করেছেন?’
আমি টেবিলের দিকে তাকিয়ে অবাক হই। একটু ভিন্ন ধরনের খাবার। বাসমতী চালের ভাত, আলু আর টমেটো দিয়ে বড় ট্যাংরার ঝোল, ইলিশের ভাজা ডিম, সরিষার তেলের খাসি ভুনা, পাটশাক দিয়ে মসুরের ডাল, নারকেল-চিংড়ি দিয়ে কলার মোচা ভাজি। রূপক মুগ্ধ হয়ে খাওয়া শুরু করেছে। আমি কোনো রকমে প্লেটে খাবার তুলে খুঁটে খুঁটে খাই। আমার সারা শরীর হিম হয়ে আছে। সবকিছু ছাপিয়ে অবাক করা কণ্ঠস্বর।
‘বাবা, আপনি খাচ্ছেন না? ভালো হয়নি?’
ঠিক যেন মায়ের কণ্ঠের আওয়াজ। আমি হকচকিয়ে যাই। আমার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। তবু মিনমিন করে বলি, ‘খাচ্ছি তো খালা। খাচ্ছি। ভালো হয়েছে তো? মায়ের হাতের রান্না কি খারাপ হতে পারে কখনো?’
ভদ্রমহিলা যেন চমকে ওঠেন। নিরীহ চোখ দুটো দিয়ে আমাকে দেখেন। তারপর ভাঙা ভাঙা শব্দে বলেন, ‘বেঁচে থাকো বাবা। বেঁচে থাকো।’
আমি একদৃষ্টিতে অবাক হয়ে আমার মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকি।