
২ বছর কিংবা তার চেয়ে বেশি সময় পার হয়ে গেছে। জাদুর শহর ঢাকা ছেড়ে নতুন একটা শহরে প্রবেশ করলাম। হ্যাঁ, আমার ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ জীবনের শুরু এখানে। নতুন শহর, নতুন মানুষ, শহর থেকে দূরে সবুজ ক্যাম্পাস, নতুন হলজীবন। নতুন এক জীবনে আমি স্বাধীনভাবে ডানা মেলা পাখি। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ক্লাস, হলে এসে রান্না, সিঙ্গেল বেডে দুজন গাদাগাদি করে শোয়া, কখনো দাবি আদায়ের আন্দোলন, কিংবা কখনো গরম চায়ের সঙ্গে গলা ফাটিয়ে গান গেয়ে রাতভর আড্ডা...আহা বিশ্ববিদ্যালয়জীবন! আমি স্থাপ্যতের ছাত্রী। তাই আমার জীবনটা একটু বেশিই ঘটনাবহুল।
স্থাপত্য বিভাগের ছাত্রী বলেই প্রায়ই শহরে যেতে হয় জিনিসপত্র কিনতে। প্রতি প্রজেক্ট জমার আগেই এমন চেহারা হয় যে অন্য বিভাগের বন্ধুরাই আমাদের চিনতে পারে না। যেন কয়েক সপ্তাহ না ঘুমিয়ে কাজ করতে থাকা কয়েকটা জীবন্ত লাশ! অবস্থা অনেকটা ‘আমায় ভাসাইলিরে, আমায় ডুবাইলি রে’ গানটার মতো। তো এমনি এক সময় প্রায় কয়েক সপ্তাহ নিদ্রা বিসর্জনের মধ্যেই শহরের উদ্দেশে রওনা হলাম। সিএনজিচালিত অটোরিকশায় আমরা তিনজন, প্রায় দেড় ঘণ্টা লাগবে শহরে যেতে। সিএনজিতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা তিনজন তিন দিকে কাত হয়ে ঘুম। একজন বাঁয়ে কাত, একজন ডানে কাত, আরেকজন সামনে। যেন কয়েক বছর সাধনার পর কয়েকজন সন্ন্যাসী নিদ্রারানিকে জয় করল। এভাবে কতক্ষণ পার হয়েছে জানি না, তবে বুঝলাম রাত হয়ে গেছে। আচমকা ঘুমের মধ্যে কিছু কথা শুনতে পেলাম। সিএনজিচালকের সঙ্গে ট্রাফিক পুলিশের কথোপকথন।
ট্রাফিক পুলিশ বলছেন, ‘লাইসেন্স নাই মিয়া আবার সিএনজি চালাও। এই রাস্তা দিয়ে যাওয়া হবে না। আজকে খবর করতেসি তোমার।’ সিএনজিচালক কাঁদো কাঁদো হয়ে বলা শুরু করল, ‘স্যার, পেছনের সিটের আপা তিনজন অনেক অসুস্থ, এদের লইয়া হসপিটালে যাইতেসি, আল্লাহ জানে কী হইব। ছাইড়া দেন স্যার, আজকে।’ চালকের পাশের ব্যক্তিও বলা শুরু করল, ‘ওনাদের হুঁশও নাই স্যার, মইরা যাইতে পারে, ছাইড়া দেন।’ আমার সঙ্গের দুজন তখনো ঘুমে, আমি ডানে কাত হয়ে ঘুমের মধ্যে সব শুনতে পাচ্ছি। ইতিমধ্যে টের পেলাম ট্রাফিক পুলিশ সিএনজির পর্দা ফাঁক করে আমাদের তিনজনকে দেখলেন। আমার ঘুমের ভেতর কথা বলার শক্তিও নেই তখন। চালক তখনো কাঁদো কাঁদো স্বরে অনুরোধ করেই যাচ্ছে।
পুলিশ ছেড়ে দিতেই চালক আর সামনের যাত্রী হো হো শব্দে হেসে উঠল। শুনলাম বলাবলি করছে, ‘আপারা আসলেই অসুস্থ নাকি!’
সেদিন মুখ খুলে কথা বলার মতো শক্তিটুকুও যেন ছিল না। তবে আজ ঘটনাটা মনে পড়লে খুব হাসি পায়। আর মনে পড়ে যাত্রা শেষে সিএনজিচালকের কথা, ‘বাঁচায় দিলেন আফা আজকে। থ্যাংক্যু।’
লেখক: দ্বিতীয় বর্ষ, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়