ব্যস্ত ব্যবসায়ী রুবি

রাত সাড়ে ১১টা। ততক্ষণে প্রায় সব দোকানপাট বন্ধ। ঢাকার শ্যামলি রিং রোডের মসজিদ মার্কেটের ‘তাওশী মটরস’ তখনো খোলা। দূর থেকেই দেখা যায়, ব্যস্তসমস্ত হয়ে দোকান চালাচ্ছেন এক নারী।
সচরাচর মোটর যন্ত্রাংশের ব্যবসা করতে দেখা যায় না মেয়েদের। কিন্তু তিনি করছেন। কীভাবে করছেন, সেটি জানতেই এক সন্ধ্যায় তাওশী মটরসের স্বত্বাধিকারী রুবি কবিরের সঙ্গে দেখা। অবশ্য তিনি তখন ভীষণ ব্যস্ত। কথা বলার ফুরসত পেলেন না। দুই দিন পর, এক সকালে ফের কথা হলো। তখনই শোনালেন হঠাৎ তাঁর ব্যবসায়ী বনে যাওয়ার গল্প।
খুব আগ্রহ নিয়ে মোটর যন্ত্রাংশের ব্যবসা শুরু করেছিলেন, তা নয়। রুবিকে এ ব্যবসায় আসতে হয়েছিল পরিস্থিতির দাবি মেনে। ব্যবসাটা প্রায় ১০ বছরের পুরোনো। দেখভাল করতেন স্বামী রওশন জামিল কবির। কিন্তু ক্রমেই ব্যবসায় লোকসান হতে লাগল। অগত্যা পারিবারিক ব্যবসা রক্ষায় হাল ধরতে এগিয়ে এলেন রুবি। বাকিটা শুনুন তাঁর মুখেই, ‘ও (স্বামী) দোকানে সময় খুব কম দিত। একজন কর্মচারীর ওপর চলত দোকান। পুরোনো ব্যবসা, লোকসান হওয়ার কথা নয়। তবে কর্মচারী লোকসান দেখাতেন। এমনই অবস্থা দাঁড়াল, ব্যবসা ভীষণ ক্ষতির মুখে পড়ে গেল। এ অবস্থা দেখে বললাম, আমি একটু চেষ্টা করে দেখি।’
রুবি দোকানের দায়িত্ব নিয়েছেন বছর খানেক হলো। এর মধ্যেই দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন ব্যবসাটা। তবে এগোনোর পথ মোটেও মসৃণ ছিল না। রুবি ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন কঠিন মুহূর্তগুলোয়, ‘শুরুতে আমার সঙ্গে অনেকে ব্যবসা করতে চায়নি। প্রধান কারণ, আমি মেয়ে। ব্যবসা পারব কি না, এমনটা ভেবে প্রতিষ্ঠানগুলো আস্থা রাখতে পারছিল না। আরেকটি কারণ ছিল, এটা লোকসানে পড়া দোকান। দীর্ঘদিন কোম্পানিদের সঙ্গে লেনদেন ঠিকভাবে করা হয়নি। তা ছাড়া আমি মেয়ে বলে শুরুর দিকে ক্রেতারাও আসতে চাইত না তেমন।’
তবু হাল ছাড়েননি রুবি। শ্রম, সাহস আর অসীম ধৈর্যে ব্যবসাকে একটা পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। সাফল্যের কথা বলতে শীতের মিষ্টি সকালে রুবির মুখে ছড়িয়ে পড়ল স্নিগ্ধ হাসি, ‘আমি নগদ লেনদেনে বিশ্বাসী। কোম্পানি, ডিলারের সঙ্গে ভালোভাবে লেনদেন করে আস্থাটা ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি। অনেকে কৌতূহল নিয়ে এখন আমাকে দেখতে আসে। আমাদের দেশে তো এ ধরনের ব্যবসায় মেয়েদের সাধারণত দেখা যায় না।’
দারুণ দক্ষতায় কেবল ব্যবসা নয়, সংসারও সামলাচ্ছেন তিনি। সাত বছরের মেয়ে তাওশী এবার দ্বিতীয় শ্রেণিতে উঠল। তিন বছরের ছেলে তাইফকে স্কুলে ভর্তি করানো হবে এবার। ভোর ছয়টায় ঘুম থেকে উঠে নাশতা তৈরি করে বাচ্চাকে স্কুলে নিয়ে যান। এরপর দোকানে চলে আসেন সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে। যেদিন ক্রেতা বা অন্যান্য ব্যস্ততা থাকে, বিকেল চারটা-পাঁচটা পর্যন্ত থাকেন দোকানেই। নইলে দেড়টা-দুইটার দিকে আদাবরের বাসায় ফিরে বাচ্চাদের খাওয়াদাওয়ার পর্ব সারেন। খানিক বিরতিতে বিকেলে আবার চলে আসেন দোকানে। এরপর সাড়ে ১১টা, কখনো ১২টা পর্যন্ত থাকেন দোকানে—এই হলো ব্যবসায়ী রুবি কবিরের দৈনন্দিন রুটিন।
হঠাৎ চলে এলেও কাজটা উপভোগ করছেন, বোঝা গেল কথাতেই, ‘ব্যবসা ভালোই লাগছে। ছেলেমেয়ে বলে কথা নয়; মনে করি, সাহস আর যোগ্যতা থাকলে যে-কেউ যেকোনো ব্যবসা করতে পারেন। অনেকে উৎসাহিত করে, কেউ আবার বাঁকা চোখেও দেখে। তবে সব ক্ষেত্রে মেয়েদের অংশগ্রহণ থাকলে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে যাবে।’
এক-দুই ধাপ করে বাড়ছে রুবির স্বপ্নের পরিধি। ভবিষ্যতে ব্যবসাটা তিনি দাঁড় করাতে চান আরও বড় কলেবরে।