ভীতি আর অস্বস্তি নিয়ে চলে নারীদের গোসল

গলি দিয়ে ঢুকে দুই সারিতে ছোট ছোট ঘর। নম্বরযুক্ত ও নম্বরহীন ‘আলগা’ ঘর। ফাঁকে ফাঁকে টয়লেট, গোসলখানা, রান্নাঘর। কোনো গোসলখানার চারপাশ ঘেরা থাকলেও ছাদ নেই, কোনোটি একেবারেই উন্মুক্ত। তেমন একটি উঁচু পাটাতনের উন্মুক্ত গোসলখানায় কুয়া থেকে পানি তুলে পাশাপাশি গোসল করছিলেন নারী ও পুরুষ। গা-ধোয়া পানি গড়িয়ে আবার কুয়াতেই ফিরে যাচ্ছিল। এই প্রতিবেদককে দেখে অস্বস্তি নিয়ে নারী সরে গেলেন। কাপড় ধুতে থাকা এক কিশোরীর সঙ্গে কথা হলো। পাশে একটি ঘর দেখিয়ে বলল, তাদের মতো কয়েক ঘরের জন্য এই গোসলখানা বরাদ্দ। নারী-পুরুষের জন্য আলাদা কোনো বন্দোবস্ত নেই। গোসল, কাপড় ধোয়া, থালাবাসন ধোয়া, মাছ-মাংস ধোয়া—সবই এখানে করতে হয়।

অধিকাংশ বস্তিতেই এ রকম খোলা জায়গায় গোসল করেন নারীরা
ছবি: নাজনীন আখতার

এ চিত্র ঢাকার ধলপুরের নিউ আদর্শ কলোনির (১৪ নম্বর আউটফল)। বাসিন্দাদের বেশির ভাগ দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে পরিচ্ছন্নতাকর্মী, আরও আছে ট্রাকে ময়লা তোলা, ভাঙারির দোকান, নিরাপত্তা প্রহরী ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের পরিবার। ওই কিশোরী জানায়, খোলা গোসলখানায় সে–ও গোসল করে। পাশে পোশাক পাল্টানোর জন্য ছাদঘেরা একটি ছোট জায়গা আছে। কখনো সেখানে যায়, কখনো ভেজা কাপড়ের ওপর তোয়ালে জড়িয়ে বাসায় চলে যায়। তাদের বাড়িটি নম্বরবিহীন। বস্তিতে সেগুলো ‘আউট ঘর’, ‘আলগা ঘর’ নামে পরিচিত। কিশোরী জানায়, এভাবে খোলা জায়গায় গোসল করাটা খুব অস্বস্তিকর। কিন্তু উপায় কী।

একই রকম আলগা ঘরের বাসিন্দা রাশিদা বেগমের (প্রকৃত নাম নয়) পাঁচজনের সংসারে মেয়ে, পুত্রবধূসহ নারী তিনজন। বললেন, ‘এই সব গোসলখানা মহিলাদের লাইগা বেসপ (অসুবিধাজনক)।’

বস্তির নারী-কিশোরীরা জানান, বস্তিতে মেয়েদের জন্য আলাদা কোনো গোসলখানা নেই। মাসিকের সময় মেয়েরা অবর্ণনীয় অস্বস্তির মধ্য দিয়ে পার করেন। মাসিকের ব্যবহৃত কাপড় তাৎক্ষণিকভাবে পরিষ্কারের সুযোগ পান না। ব্যবহৃত কাপড় জমিয়ে রেখে সন্ধ্যার পর গোসলখানা নিরিবিলি হলে ধুতে যান। আরেক শঙ্কা, গোসলের দৃশ্য কেউ ভিডিও করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয় কি না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ বস্তি শুমারি ও ভাসমান লোকগণনা ২০১৪ প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা সদর ও অন্যান্য অঞ্চলে বস্তির সংখ্যা ১৩ হাজার ৯৩৮। সেসব বস্তিতে ২২ লাখ মানুষ বাস করছে, যার অর্ধেকই নারী।

গোসল, কাপড় ধোয়া, থালাবাসন ধোয়া, মাছ-মাংস ধোয়া—সবই এক জায়গায় করতে হয়
ছবি: নাজনীন আখতার

বিবিএস ও ইউনিসেফের ‘চাইল্ড ওয়েলবিয়িং সার্ভে ২০১৬’ অনুসারে সিটি করপোরেশন এলাকায় বসবাসরত ব্যক্তিদের এক-তৃতীয়াংশই বস্তিতে বাস করে। সেই হিসাবে ঢাকায় বস্তিতে থাকে আনুমানিক ৬১ লাখ মানুষ। উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২০২০ সালের তথ্য অনুসারে, ঢাকার লোকসংখ্যা ১ কোটি ৮৪ লাখ।

নেই নিরাপদ গোসলখানা

জীবিকার প্রয়োজনে মানুষ গ্রাম থেকে নগরে আসছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে বস্তির সংখ্যা। অবকাঠামোগত দুর্বলতা, যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তার অভাবে বস্তিগুলো নারী ও শিশু বাসিন্দাদের জন্য কঠিন ও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। ন্যূনতম মৌলিক সেবা পাওয়া কঠিন। এর মধ্যে একটি হচ্ছে নিরাপদ গোসলখানা।

কলোনির আরেক কিশোরী মানিকনগর মডেল হাইস্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ছে। সে বলে, দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে গোসলের সুযোগ পাওয়া যায়। দুপুরের সময় গোসলের চাপ বেশি থাকে। ওই সময় পুরুষেরাই দখলে রাখেন গোসলখানা। অনেক সময় অপেক্ষা করতে করতে বিরক্তি এসে যায়। তবে স্কুলে পড়ার কারণে সে মেয়েদের অনলাইনভিত্তিক যৌন হয়রানির বিষয়ে অবগত। তাদের জন্য বরাদ্দ গোসলখানাটির দুই দিক ঘেরা। তবে ছাদ খোলা। বলল, ‘প্রায়ই ভয় লাগে, কেউ যদি গোসলের দৃশ্য ভিডিও করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়!’

নিউ আদর্শ কলোনির পঞ্চায়েত কমিটির সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম জানান, কলোনিতে নিবন্ধিত নম্বরযুক্ত ঘর ১৫০টি। নিবন্ধন ছাড়া আলগা ঘর ৫০টির মতো। আনুমানিক ১ হাজার ২০০ লোকের বাস। বস্তিতে মোট চারটি পয়েন্টে ২৪টির মতো টয়লেট আছে। আর গোসলখানা আছে ৮টি। একেকটি গোসলখানা গড়ে ১৫০ জনের জন্য বরাদ্দ। তিনি বলেন, অনেকের জন্য একটি গোসলখানা বলে লাইন পড়ে। এ ছাড়া খোলা গোসলখানা হওয়ায় মেয়েরা বেশ সমস্যায় পড়ে। এই সব সমস্যার কথা জানিয়ে বিভিন্ন সময়ে তাঁরা বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ জানিয়েছে, এমপাওয়ারিং গার্লস ফর ইকোনমিক অপরচুনিটিজ অ্যান্ড সেফ স্পেস (অর্থনৈতিক সুযোগ ও নিরাপদ স্থানের জন্য মেয়েদের ক্ষমতায়ন) বা ইগ্লস প্রকল্পের আওতায় পপুলেশন সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের (পিএসটিসি) মাধ্যমে মেয়েদের জন্য রাজধানীর চারটি বস্তিতে ছাদ দেওয়া ১৫টি গোসলখানা নির্মাণ করা হচ্ছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। নিউ আদর্শ কলোনিতেও ৩টি গোসলখানা নির্মাণ করা হচ্ছে।

মাসিকের সময় সংকট বেশি

নিউ আদর্শ কলোনির নম্বরযুক্ত একটি বাড়িতে স্বামী ও তিন বছরের সন্তান নিয়ে থাকেন শিউলি আক্তার (ছদ্মনাম)। ৪ বছর আগে ১৫ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে গ্রাম ছেড়ে চলে আসেন ঢাকায়। শিউলির শ্বশুর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ট্রাকে ময়লা তোলার কাজ করেন। সেই সূত্রে বরাদ্দ পাওয়া ঘরে বসবাস করছেন। তিনি বললেন, শহুরে জীবন শুরুর পর তাঁর বড় ধাক্কা লেগেছে ছাদ খোলা উন্মুক্ত গোসলখানায় গোসল করতে হবে ভেবে। গ্রামে বাড়ির গণ্ডির মধ্যে পুকুরে গোসল করতে এত অস্বস্তি হতো না। মাসিকের সময় অস্বস্তি আরও বেশি। মাসিকের সময় তিনি ন্যাকড়া ব্যবহার করেন। দিনের বেলা গোসলখানায় পুরুষদের আনাগোনা বেশি। আর অপেক্ষমাণ সারিও লম্বা। এ কারণে মাসিকের সময় তাৎক্ষণিকভাবে ন্যাকড়া পরিষ্কার করতে পারেন না। ঘরের এক কোনায় জমিয়ে রাখেন। সন্ধ্যার পর গোসলখানা নিরিবিলি থাকে, তখন এসে ন্যাকড়া পরিষ্কার করেন। ঘরের ভেতর শুকাতে দেন।

নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক কিশোরী জানাল, সে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে। তবে তার মা ন্যাকড়া ব্যবহার করেন। মাকেও একই সমস্যায় পড়তে হয়।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মানিক কুমার সাহা জানান, বাংলাদেশে পাঁচ হাজারের বেশি নিম্ন আয়ের এলাকা রয়েছে। যেখানে অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা এখনো অপ্রতুল। নেই মেয়েদের জন্য আলাদা কোনো গোসলের স্থান। সেসব এলাকায় বসবাসরত কিশোরী ও যুব নারীদের জন্য এটি একটি কঠিন বাস্তবতা। মাসিকের সময় যা আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। পৃথক গোসলখানা না থাকায় তাঁদের উন্মুক্ত স্থানে গোসল করতে গিয়ে সম্মুখীন হতে হচ্ছে নানা রকম সহিংসতার, হয়রানির। তিনি আরও বলেন, সমস্যাটা যে গুরুতর, তা অনুধাবন করে নীতিনির্ধারকদের পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি ওই সব এলাকার পুরুষদেরও পরিবারের মেয়েদের নিরাপত্তার কথা ভেবে সচেতন হতে হবে।