ভোর পাঁচটায় বিদ্যালয়ে যাত্রা সন্ধ্যা সাতটায় ফেরা!

খাগড়াছড়ির দীঘিনালার তৈদুছড়া ও ​সীমানাপাড়া এলাকার এই শিশুদের বিদ্যালয়ের পথে যাত্রা শুরু হয় খুব ভোরে। ফিরে আসতে  আসতে গড়িয়ে যায় সন্ধ্যা l প্রথম আলো
খাগড়াছড়ির দীঘিনালার তৈদুছড়া ও ​সীমানাপাড়া এলাকার এই শিশুদের বিদ্যালয়ের পথে যাত্রা শুরু হয় খুব ভোরে। ফিরে আসতে আসতে গড়িয়ে যায় সন্ধ্যা l প্রথম আলো

খাগড়াছড়ির দীঘিনালার তৈদুছড়া এলাকায় চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র রিটন ত্রিপুরা ভোর পাঁচটায় ঘর থেকে বের হয় বিদ্যালয়ের উদ্দেশে। তিন ঘণ্টা টানা হেঁটে আট কিলোমিটার দূরে নয়মাইল গুচ্ছগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রিটন পেঁৗছায় সকাল আটটায়। আবার বিকেল চারটায় বিদ্যালয় ছুটি হলে ঘরে ফিরতে ফিরতে বেজে যায় সন্ধ্যা সাতটা।
কেবল রিটন নয়, এভাবে প্রতিদিন দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বিদ্যালয়ে যায় দীঘিনালার দুর্গম তৈদুছড়া ও এর পাশের সীমানাপাড়া গ্রামের শিশুরা। এই দুটি গ্রামে দেড় শ পরিবারের বসবাস হলেও কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। অথচ গ্রাম দুটির প্রায় ৬০ জন শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায়। এদের মধ্যে ২০ জন পড়ে নয়মাইল গুচ্ছগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এই ২০ জন শিক্ষার্থীকে রিটনের মতোই দীর্ঘ সময় হেঁটে বিদ্যালয়ে যেতে হয়। ওই এলাকায় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা গ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি।
দীঘিনালা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে সীমানাপাড়া গ্রামের অবস্থান। তার আরও দুই কিলোমিটার পর তৈদুছড়া গ্রাম। সম্প্রতি সীমানাপাড়া গ্রামে পাহাড়ি রাস্তায় দেখা হয় রিটন চাকমাসহ কয়েকজন শিশুর সঙ্গে। বিকেল সাড়ে চারটায় বিদ্যালয় ছুটির পর বাড়ি ফিরছিল তারা। শিশুরা জানায়, তাদের বিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু হওয়ার সময়সূচি ভিন্ন হলেও একসঙ্গে বিদ্যালয়ে যায় এবং একসঙ্গে ফিরে আসে। রিটন ত্রিপুরা জানায়, তার ক্লাস শুরু হয় দুপুর ১২টায়। কিন্তু গ্রামের অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একসঙ্গে যেতে হয় বলে খুব ভোরেই রওনা দিতে হয়। বাড়ি ফিরে ভীষণ ক্লান্ত লাগে তার। এত দীর্ঘ পথ হেঁটে যাতায়াতের পর আর পড়ালেখা করার মতো শক্তি থাকে না। তার সহপাঠীদের বক্তব্য একই। শিক্ষার্থী দয়ন ত্রিপুরা, ধিমেন ত্রিপুরা ও অন্তু ত্রিপুরা জানায়, বিদ্যালয় শুরুর অনেক আগে পৌঁছাতে হয় তাদের। আবার ছুটির পর একসঙ্গে সবাই মিলে আসার জন্য অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘ সময়। সীমানাপাড়া ও তৈদুছড়া গ্রামের ২০ জন শিশুর দৈনিক রুটিন এমন। এরা সবাই নয়মাইল গুচ্ছগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থী।
সীমানাপাড়া গ্রামে গেলে কথা হয় গ্রামের বাসিন্দা পরানধন ত্রিপুরা (৫৫), ধনরঞ্জন ত্রিপুরা (৬০) ও পিলানী ত্রিপুরার সঙ্গে। তাঁরা জানান, সীমানাপাড়ায় ৮০টি পরিবারের বসবাস। আর তৈদুছড়া এলাকায় রয়েছে ৭০টি পরিবার। দুই গ্রামের দেড় শ পরিবারের শিশুদের পড়াশোনার জন্য কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। এই গ্রামে একটি ব্র্যাক স্কুল থাকলেও সেখানে সবার পড়ার সুযোগ হয় না। গ্রামের শিক্ষার্থীরা নয় মাইল গুচ্ছগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অনেক দূরের বিদ্যালয়ে গিয়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। বিদ্যালয় অনেক দূরে হওয়ায় ঝড়বৃষ্টি হলে শিশুরা বিদ্যালয়ে যেতে পারে না। প্রত্যেকেই সাত-আট কিলোমিটার হেঁটে বিদ্যালয়ে যায়।
গ্রামের আরেক বাসিন্দা রহি রঞ্জন ত্রিপুরা জানান, তাঁর দুই মেয়ের মধ্যে একজন দ্বিতীয় শ্রেণি ও আরেকজন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। তাদের খাগড়াছড়ি সদরে ভাড়া বাসায় রেখে খাগড়াপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন তিনি। গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলে মেয়েদের বাড়িতে রেখেই পড়াতে পারতেন বলে আক্ষেপ করেন রহি রঞ্জন।
নয়মাইল গুচ্ছগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিিক্ষকা প্রীতিলতা ত্রিপুরা বলেন, সীমানাপাড়া ও তৈদুছড়া এলাকা থেকে শিক্ষার্থীরা খুব কষ্ট করে বিদ্যালয়ে আসে। বিদ্যালয় শুরুর আগেই উপস্থিত হয় তারা। এখানে একেক শ্রেণির পাঠদান একেক সময় শুরু হয়। কিন্তু এই দুই গ্রামের শিক্ষার্থীদের একসঙ্গে আসতে হয় বলে তারা ক্লাস শুরুর আগে এসে পেঁৗছায়।
প্রীতিলতা আরও বলেন, কয়েক দিন আগে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র রিটন ত্রিপুরার অভিভাবক বিদ্যালয়ে এসেছিল। বিদ্যালয়ে যাতায়াতে দীর্ঘ সময় লাগায় ছেলের খাওয়াদাওয়ায় অনিয়ম হচ্ছে বলে তাঁরা জানিয়েছেন। তবে রিটন ভোর পাঁচটায় বাড়ি থেকে বের হয় বলে তাকে খাবারও দেওয়া সম্ভব হয় না।
দীঘিনালা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নব কমল চাকমা বলেন, ‘সীমানাপাড়া এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকার বিষয়টি শুনেছি। গ্রামের শিশুরা হেঁটে অনেক দূরের বিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশোনা করে। কীভাবে সীমানাপাড়া গ্রামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা যায় সে চেষ্টা করা হবে।’