নবম শ্রেণির ছাত্রী সীমা (ছদ্মনাম) কয়েক বন্ধু মিলে প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে হালের জনপ্রিয় এক সিনেমা দেখার পরিকল্পনা করল। বছর তিনেক আগেও এমন পরিকল্পনায় সীমা শামিল হয়েছিল, কিন্তু বাড়ি থেকে অনুমতি মেলেনি। এবার ওরা বেশ গোঁ ধরে রইল, এবার দেখবেই। সীমা মায়ের কাছে গিয়ে অনুমতি চাইল। এবার মা প্রথমেই না করেননি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে কোন কোন বন্ধু যাবে, তাদের নাম শুনে নিলেন। বন্ধুদের মধ্যে দুজন মেয়ে, তিনজন ছেলে। এরপর মা প্রত্যেক বন্ধুর অভিভাবককে ফোন দিলেন ঘটনা যাচাইয়ের জন্য। ছেলেদের মা–বাবার কোনো আপত্তি নেই। সমস্যা মেয়েদের অভিভাবকদের। এরপর সীমা ও তার বান্ধবীদের মা–বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন, তাঁদের একজন সিনেমা হলে মেয়েদের পৌঁছে দিয়ে টিকিট কেটে দিয়ে আসবেন। সিনেমা শেষ হওয়ার সময় আরেক অভিভাবক গিয়ে নিয়ে আসবেন।
সীমা জানাল, সে বড় হচ্ছে, অথচ তার স্বাধীনতা নেই। ছোটবেলার মতো এখনো স্কুলে যাওয়ার সময় মা সঙ্গে যান। কোচিং করার সময় মা বসে থাকেন। স্কুলের পিকনিক বা বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও যাওয়ার অনুমতি মা-বাবা কখনো তাকে দেন না। সীমার মা বললেন, ‘দেশে যেভাবে নারী নির্যাতনের খবর পাই, তাতে মেয়েকে নিয়ে প্রচণ্ড ভয়ে থাকি। কারও সঙ্গে মেয়েকে বাইরে যেতে দিয়ে শান্তি পাই না। মেয়ে কখনো কোনো বিপদে পড়ে কি না, সেই দুশ্চিন্তায় সব সময় একধরনের অস্থিরতা কাজ করে। রাতের বেলা আমিও বাড়ির বাইরে থাকতে ভয় পাই।’
ঢাকার গুলশানের একটি সুপারশপের কর্মী শেফালী (ছদ্মনাম) রাত নয়টার দিকে কাজ শেষ করে বাড়ি ফেরেন। বাসা আবদুল্লাহপুর। প্রতিদিন আরও এক মেয়ে কর্মীর সঙ্গে বাড়ি ফেরেন। সেদিন একা ছিলেন। বাসে উঠতে গিয়ে খেয়াল করেন, বাসটি বেশ ফাঁকা। সাত-আটজন পুরুষ ছড়িয়ে–ছিটিয়ে বসা। টাঙ্গাইলে রূপার (চলন্ত বাসে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার) কথা মনে পড়ে বুকের ভেতর ধক করে উঠল। বাসে না উঠে বেশি টাকা খরচ করে সিএনজিচালিত অটোরিকশার গ্রিলের খাঁচার ভেতর ঢুকে পড়লেন তিনি। তবে সেখানেও যে ভয় লাগছিল না, তা নয়।
সহিংসতার শিকার হওয়ার ভয়ে এমন অনেক মেয়ে, তরুণী, নারীর স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হচ্ছে। জেন্ডার ইস্যু নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, নারী নির্যাতনের ঊর্ধ্বগতি নারীদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে, যা থেকে এ ভয় তৈরি হয়। ভয় আরও বাড়ে যখন অপরাধের তুলনায় অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়ার নজির কম থাকে। ‘আমিও এমন ঘটনার শিকার হতে পারি, আমিও হয়তো বিচার পাব না’—এই আশঙ্কায় কুঁকড়ে যায় জীবন। বাড়ি, সড়ক, যানবাহন, কর্মস্থল কোথাও নারীরা নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারেন না।
করোনাকালে নির্যাতন আরও বেড়েছে
২০২০ সালে দুই দফা করোনাভাইরাসের উচ্চ সংক্রমণে দীর্ঘ একটি সময় বাড়িতে দিন কাটিয়েছে মানুষ। কিন্তু তাতে কি নির্যাতন কমেছে? না, উল্টো বেড়েছে। বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র নয়টি পত্রিকা এবং নিজস্ব পর্যবেক্ষণে নারী ও শিশু নির্যাতনের তথ্য সংকলিত করে। সেই তথ্য অনুসারে, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর হত্যার শিকার ৭৬ জন। ২০২০ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১ হাজার ৬২৭ জন। ধর্ষণের পর হত্যার শিকার ৫৩ জন।
পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ২০১৯ সালে ৪২৩টি। এর মধ্যে হত্যার শিকার ৩১১ নারী। ২০২০ সালে ৫৫৪টি পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে হত্যার ঘটনা ৩৬৭।
যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২০১৯ সালে ১৬৭ জন। তাঁদের মধ্যে হত্যার শিকার ৯৬ জন এবং ২০২০ সালে ২১৮ জন নির্যাতনের শিকার, হত্যার শিকার ৮৯ জন।
২০২১ সালের প্রথম ৭ মাসে ধর্ষণের শিকার ৮১৮ জন, ধর্ষণের পর হত্যার শিকার ৩১ জন; পারিবারিক নির্যাতনের শিকার ৪১৯ জন, এর মধ্যে হত্যার শিকার ১২৬ জন; যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতন ১৪৭ ও হত্যার শিকার ৫০ জন।
যা বলেছেন মেয়েরা
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এ বছরের জুন থেকে আগস্ট—তিন মাস ধরে ‘সহিংসতার ভয়’ শিরোনামে ৮টি বিভাগের ৪ হাজার ৩০৫টি পরিবারের ওপর একটি জরিপ পরিচালনা করেছে। এতে অংশ নিয়েছেন ৮ হাজার ৮৫৪ জন কিশোরী, তরুণ-তরুণী এবং বাবা-মা। এর মধ্যে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী কিশোরী ও তরুণীর সংখ্যা ২ হাজার ২৩২। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্রসহ বিভিন্ন স্থানে চলার পথে এবং অনলাইনে ওই মেয়েরা সহিংসতার শিকার হওয়ার যে ভয় নিয়ে চলেন, সেসব অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন। এ ভয়ের অভিজ্ঞতা তাঁদের ওপর কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তা নিয়েও কথা বলেছেন। জরিপ প্রতিবেদনটি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি।
জরিপে অংশ নেওয়া মেয়েদের অভিজ্ঞতার কিছু অংশ তুলে ধরে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের পরিচালক (মেয়েদের অধিকার) কাশফিয়া ফিরোজ প্রথম আলোকে বলেন, ওই মেয়েরা সহিংসতার ভয় তাঁদের বড় হতে, বেড়ে উঠতে কতটা বাধার সৃস্টি করে, তা জানিয়েছিলেন। তাঁরা বাসা থেকে একা বের হতে ভয় পান। তাঁদের সামাজিক সম্পৃক্ততা কমে যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক বা সহপাঠীর নেতিবাচক ব্যবহার নিয়ে অনেক মেয়ে বলেছেন, তাঁদের পড়াশোনায় মনোযোগ কমে যায় এবং পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়। অনেকে সাময়িকভাবে স্কুলে যাওয়া বন্ধ রাখে। অনেক মেয়ে বলেছে, মা–বাবার দ্বন্দ্ব তাদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আবার অনেক মা-বাবা ভীতি থেকে মেয়েকে চোখে চোখে রাখেন, বাল্যবিবাহ দিয়ে দেন। দেখা যায়, ওই মেয়েরা সমবয়সী ছেলেদের সঙ্গে কথা বলতেও ভয় পায়। কর্মক্ষেত্রে দুর্ব্যবহার, বেতনবৈষম্যে অনেক মেয়ে চাকরিও ছেড়ে দেয়। সহিংসতার শিকার হওয়ার পর খুব অল্পসংখ্যক মেয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন বলে জানিয়েছেন।
ভয় ঠেলে জয়ী হতে হবে
মেয়েদের ভয় ঠেলে জয়ী হওয়ার ওপর জোর দিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান জোবেদা খাতুন। তিনি বলেন, জীবনে চলার পথে অনেক প্রতিকূলতা থাকে, ঝুঁকি থাকে। সেসব সঙ্গে নিয়েই চলতে হবে, মোকাবিলা করা শিখতে হবে। এ কারণে ছোটবেলা থেকে জীবনে চলার জন্য তাদের দক্ষতা শেখাতে হবে। নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনার বাইরে পরিবারকে প্রতিকূলতা ঠেলে জয়ী হওয়া মেয়েদের গল্পগুলোকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরতে হবে। ছোট থেকেই বোঝাতে হবে, প্রতিটি সমস্যারই সমাধান আছে।
পরিবার থেকে মেয়েদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা শেখানোর পাশাপাশি নারীদের কীভাবে সম্মান করতে হয়, ছেলেদের তা শেখাতে হবে বলে মনে করেন জোবেদা খাতুন। তিনি বলেন, নারীকে মর্যাদা দিতে শেখা কোনো পুরুষ কখনো ধর্ষক, নিপীড়ক হতে পারে না। সমাজকে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ভূমিকা পালন করতে হবে। আর রাষ্ট্রকে নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগ আরও বাড়াতে হবে এবং বিচারপ্রক্রিয়াকে দ্রুত ও শক্তিশালী করতে হবে।