মনের নকশায় আলপনা

আলপনায় যেন ফুটে ওঠে মনের নকশা।ছবি: ফাইল ছবি

চালের গুঁড়ি, ইটের গুঁড়ি, হলুদবাটাসহ নানা সহজলভ্য উপকরণ দিয়েই করা হতো আলপনার নকশা। তবে এখন তৈরি করা নানা রকম রং দিয়ে সহজেই আলপনা আঁকা যায়।

পাঠকের হাতে যখন নকশার এই প্রতিবেদন, তখন পেরিয়ে গেছে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। ফেব্রুয়ারির বিশতম দিনে বিকেল থেকেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় আঁকা হতে থাকে আলপনা। একুশে ফেব্রুয়ারি ছাড়া সমষ্টিগতভাবে এমন আলপনা আঁকা হয় অন্যান্য উপলক্ষেও; তবে ইতিহাস বলে, বাড়ির উঠান, ঘরের মেঝে, দেয়াল, দরজার পাল্লায় আলপনা করা হতো ব্যক্তি বা পারিবারিক উদ্যোগেই। চালের গুঁড়ি, ইটের গুঁড়ি, হলুদবাটাসহ নানা সহজলভ্য উপকরণ দিয়েই করা যেত সেসব নকশা। তবে এখন তৈরি করা নানা রকম রং দিয়ে সহজেই আলপনা আঁকা যায়।

বাঙালির নানা উৎসবেই আলপনা উজ্জ্বল। উৎসবমুখী ছাড়াও রয়েছে অলঙ্করণমুখী আলপনা। সব ক্ষেত্রেই এর কারুকাজের ধারা বা প্যাটার্ন উঠে আসে প্রকৃতি থেকেই। একটা লতার বেড়ে ওঠার ভঙ্গি, গাছের একটা ডালের পত্রপল্লব বিকশিত হওয়ার ধরন, সেই বিকাশের মাধুর্য, সেই পরিপূর্ণতার মিষ্টতা খুঁজে পাওয়া যায় ভিন্ন এই নকশায়। একটি মোটিফের পুনরাবৃত্তি দিয়েই নান্দনিক হয়ে ওঠে আলপনা। ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী আলপনার থাকে কিছু নির্দিষ্ট ধারা। কত বড় হবে, কোথায় গিয়ে থামবে, তার কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। শিল্পী যেখানে চাইবেন, সেখানেই থামিয়ে দেওয়া যায় মোটিফের পুনরাবৃত্তি তথা কারুকাজ, জানালেন শিল্পী সব্যসাচী হাজরা।

আলপনার নকশা

আলপনায় থাকে সাদার প্রাধান্য। কালো বা কালচে রঙের বুকে সাদার ছোঁয়ায় একটা বৈপরীত্য আসে। সাদার সঙ্গে কিছু অন্য রংও থাকে অবশ্য, তবে তা প্রাধান্য পায় না। লতা-পাতা-ফুল এ রকম আমাদের খুব পরিচিত কিছু উপাদানই থাকে আলপনায়। এই লতা, ফুল সবই পরিচিত পরিবেশ থেকে পাওয়া। শিল্পীর আলপনায় থাকে মাপজোখ। নকশায় পুনরাবৃত্তি হয়, একই নকশার কিছুটা পুনর্গঠনও হতে পারে। এভাবেই স্বল্প সময়ে বড় কোনো তলে গড়ে তোলা হয় বিশাল কোনো নান্দনিক আলপনা। বৃত্ত, বাঁক, কোণ—নানা ধাঁচে করা হয় আলপনা। দেশ-দেশান্তরের আলপনা যেমন আলাদা, তেমনি ভিন্নতা রয়েছে দেশের বিভিন্ন অংশের আলপনায়ও। চারপাশের পরিচিত পরিবেশটাই যেন আলপনায় শিল্পীর অনুপ্রেরণা।

আলপনা আজ

সব্যসাচী হাজরার ভাষায়, একুশের প্রথম প্রহরে খালি পায়ে হাঁটার সময়টায় পিচঢালা রাস্তা আলপনাবিহীন, এমনটা ভাবা যায় না। পথের বুকে আন্দোলনের ইতিহাস রয়েছে আমাদের, পথের এই আলপনায় ফুটে ওঠে সেই আবেগ, সেই স্মৃতি; শোককে শক্তিতে পরিণত করার সেই অনুভূতি। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জীবনধারায় রয়েছে দেশজ রং, দেশজ উপকরণে করা তাদের নিজস্ব আলপনা। এতে উঠে আসে তাদের নিজস্বতার গল্প।

এর বাইরে পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে এই নকশার ব্যবহার আজও দেখা যায়। একসময় গ্রামাঞ্চলের নারীরা গোবর দিয়ে উঠান লেপার পর চালের গুঁড়ি দিয়ে আঁকতেন হাতের আঙুলের সাহায্যেই। ছিল না কোনো তুলির ব্যবহার। তবে এখন রংতুলি দিয়েই আঁকা হয় আলপনা। প্লাস্টিক রং ব্যবহার করা যায় উপযোগী কোনো তুলির সাহায্যে। তুলি বেছে নিতে হবে অঙ্কনতলের ধরন বুঝে। সাধারণ মসৃণ তলে আলপনা আঁকতে সাধারণ তুলিই যথেষ্ট। তবে সড়কের অমসৃণ তলে আঁকতে হলে চাই এমন কিছু, যা দ্রুত ক্ষয়ে যায় না। এ রকম ব্রাশ কিনতে পাওয়া যায়; আবার স্কুলের বোর্ড মোছার ডাস্টার কিনে নিয়ে তা লাঠির মাথায় বেঁধে বড় আকারের নকশাও আঁকা যায়।