মনের বাক্স

পৃথিবীটা আসলেই ছোট

আমি, অধরা, পপি, রাব্বী, রানা—সবাই তখন গাজীপুরে এশিয়ান ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়তাম। স্কুলে আমাদের আসা-যাওয়া ছিল পাখির খাঁচার মতো স্কুলভ্যানগুলোতে করে। এই ছোট্ট বাচ্চাগুলোর মধ্যেও ছিল অলিখিত মেয়ে বনাম ছেলের সব সময়ের হাস্যকর প্রতিযোগিতা। মেয়েদের যেভাবেই হোক বসতে হবে স্কুল ভ্যানের সামনের দিকে।

স্কুলটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, বৃহস্পতিবার স্কুল ইউনিফর্ম ছাড়া যাওয়া, সবাই মুখিয়ে থাকতাম দিনটির জন্য। সবাই যার যার সুন্দর পোশাক পরতাম দিনটিতে।

আজকে সকালে স্কুলটির একটি ঘটনা খুব মনে পড়ছিল। গতানুগতিকভাবে সেই দিনটিও ছিল অন্য সব বৃহস্পতিবারের মতো। আমাদের ভ্যানমেটে এর মধ্যে যোগ হয়েছিল অধরার বোন অর্থীও। অধরার আম্মুর প্রতিদিনের কড়া আদেশ ছিল ছুটির সময় অর্থী সব বই-খাতা ব্যাগে ঢুকিয়েছে কি না, দেখে নেওয়া। সবাই যার যার পছন্দের পোশাকটি পরেছিল সেদিন। অধরা পরেছিল একটি নীল রঙের ফ্রক, পরি পরি লাগছিল তাকে। স্কুল শেষে সে বড় বোনের দায়িত্ব পালন করার জন্য যাচ্ছিল ছোট বোন অর্থীর ব্যাগ দেখতে। যখনই ব্যাগটা ধরতে যাবে, রাব্বি ব্যাগটা অধরার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে নিল, বেড়ে গেল আমাদের মেয়েপক্ষের রাগ। আমরাও ঝগড়াঝাঁটি করে ব্যাগটা জিতে নিলাম। অর্থীর পেনসিল বক্সটা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই চোখে পড়ল একটা চিরকুট। চিরকুটের লেখাগুলো কিছুটা প্রেমপত্রের মতো। প্রতি শুক্রবারের সিনেমা দেখে প্রেমপত্র সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞানটা ভালোই ছিল আমাদের।

ইংলিশ মিডিয়ামের বাচ্চাদের বাংলা লেখা সাধারণত খারাপ হয়, এ ক্ষেত্রেও তাই হলো। বিচ্ছিরিভাবে কয়েকটা শব্দ লেখা ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি অধরা’। ক্লাস সিক্সে আমরা একেকজন একেক স্কুলে চলে এলাম। আমি চলে এলাম ঢাকায়, অধরা চলে গেল মিরপুরে।

হঠাৎ আজ সন্ধ্যায় অধরার ফোন, প্রথম কথাটাই ছিল, ‘জানো, কালকে কমলাপুর স্টেশনে রাব্বির সঙ্গে দেখা। ও হয়তো আমাকে চিনতে পারেনি।’ আর আমি মনে মনে ভাবছিলাম পৃথিবীটা আসলেই ছোট।
ফারহানা ইসলাম

 তোকেই বলছি

তুই যদি হাজারবারও আমাকে অবহেলা করিস, এক শ দিন আমার ফোনের উত্তর না দিস, তারপরও তোর একটা ফোন, তোর একটা কথা আমি স্বর্গের দেবীর মতো শুনি, আমার সব না-পাওয়া, সব অপারগতা, সব ভুলে যাই। তোর কণ্ঠ আমার কানে যখন প্রবেশ করে, আমি আমার অবস্থান ভুলে যাই। রক্তকণিকার চঞ্চলতা তোর অস্তিত্বের প্রমাণ দেয়। তোকে যখন দেখি, আমি আমার কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি। পারিপার্শ্বিক অন্য কোনো ভাবনা আমার চিন্তারাজ্যে যাওয়ার পথ খুঁজে পায় না। এই বিশ্বজগতের সমস্ত সৌন্দর্যের একীভূত রূপ আমার সীমিত দৃষ্টিশক্তির সমস্ত সীমারেখা লঙ্ঘন করে যায়।

তোর অনুভবে আমার জীবনীশক্তি এক শ গুণ ক্ষমতা পায়। বহু আগে, বহু দূরে চলে যাওয়া আত্মশক্তি নতুন জীবন পায়। ভরা রৌদ্রে সারা দিন হাঁটার পরও এক শ মাইল দৌড়ানোর মনোবল পায়। হ্যাঁ তোকেই বলছি। তোকেই। তুই-ই আমার সব ‘তুই’, সব ‘তুমি’।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

 হঠাৎ ঘুম ভাঙা

রাত তখন আনুমানিক তিনটা বাজে, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেছে। দেখি জোছনার আলোয় তোমার মুখখানি কী অপরূপ লাগছে। জানালার দিকে তাকাতেই কী সুন্দর আকাশে যেন ক্যান্ডেল নাইট ডিনার চলছে। চারদিকে নিশ্চুপ পরিবেশ। ভাবছি, তোমাকে ডেকে জানালার পাশে একসঙ্গে বসে এই সুন্দর বসুন্ধরায় হারিয়ে যাব। আবার ভাবছি, না থাক, ঘুম থেকে এত রাতে ডাকলে পাগল বলবে আমাকে। তাই একাই একবার জানালার পাশে তো আরেকবার বারান্দায়। মনে হচ্ছে ঘুম বুঝি আজ আর আসবে না। তুমি হঠাৎ করে আমার হাত ধরলে। ভয় পেয়েছিলাম। তারপর তোমার সঙ্গে গল্প করতে করতে কখন যে রাত পেরিয়ে সকালে অ্যালার্ম বেজে উঠল বুঝতেই পারলাম না।
রায়হান, দিনাজপুর।

 সরি রাজকুমারী!

জানি না তুমি কেমন আছ। অনেক দিন হলো তোমার কোনো খোঁজখবর পাই না। আর পাবই বা কী করে! তোমার-আমার মাঝে যে বিচ্ছেদের উঁচু প্রাচীর গড়ে উঠেছে, তা টপকে তোমাকে একপলক দেখতে চাওয়ার সাধ থাকলেও সাধ্য যে আমার নেই। সবকিছু কিন্তু ঠিকঠাকমতো চলছিল, তাই না রাজকুমারী? আমি দিনে দিনে আমার কল্পনার জগতে তোমাকে নিয়ে একটা রাজ্য বানিয়ে ফেলেছিলাম।

তোমার দীঘল ঘন ভ্রুযুগল আর চঞ্চলা মায়াবী দুটি চোখ আমাকে অন্য রকম একটা মুগ্ধতায় ভাসাত সারাক্ষণ। তোমার চোখের পলক পড়লে আমার মনে হতো একটা সুখী প্রজাপতি ডানা ঝাপটাচ্ছে। তোমাকে রাজকুমারী বলে ডাকতাম।

তারপর অনেকগুলো দিন কেটে গেল আমাদের। ব্যস্ততা বেড়ে গেল। কিন্তু তারপরও আমি সারাক্ষণ তোমার অপেক্ষায় থাকতাম, অপেক্ষাটা ছোট্ট একটা বার্তার জন্য। ব্যস্ত থাকলেও কখনোই তোমাকে বুঝতে দিতাম না। কিন্তু একটা সময় তুমি যেন কেমন হয়ে গেলে। তোমার পৃথিবী থেকে আমার অস্তিত্ব আস্তে আস্তে বিলীন হতে লাগল। তোমার সেই আকস্মিক বদলে যাওয়াটা আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারিনি। তোমার পৃথিবীতে সবই ছিল—বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি, আড্ডা, ফেসবুকিং—সবকিছুই ছিল। শুধু দিন শেষে আমার জন্য একটু সময় ছিল না তোমার। একটু সময় ছাড়া আর কিছু চেয়েছিলাম তোমার কাছে? কখনোই চাইনি।

শেষের দিকে তোমার অবাধ্যতা, আমার প্রতি তোমার চরম নির্লিপ্ততা আমাকে যেন আরও মানসিক বিকারগ্রস্ত বানিয়ে ফেলল। দুজন একই শহরে বাস করেও কেন জানি মনে হচ্ছিল তুমি আমার থেকে লাখ লাখ আলোকবর্ষ দূরে চলে যাচ্ছ। প্রত্যেক মানুষেরই সহ্যের একটা সীমা থাকে, আমার সহ্যের বাঁধটা শত চেষ্টা করেও আর টিকিয়ে রাখতে পারিনি। আর তাই তোমাকে মেসেঞ্জারে অনেক বকাঝকা করেছিলাম। তুমি সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিলে। তোমাকে সরিটাও আর বলতে পারিনি। আর তাই আজকের এই আয়োজন।

রাজকুমারী তোমার মনে আছে? তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে কোনো এক পূর্ণিমায় আমরা সমুদ্রজ্যোৎস্না দেখব। মনে আছে তোমার রাজকুমারী? জানো রাজকুমারী? আমার পৃথিবীতে নিকষ কালো অন্ধকার নেমে আসে ঠিক তখনই, যখন মনে পড়ে সমুদ্রজ্যোৎস্না দেখতে চাওয়া রাজকুমারীটা আমাকে আর ভালোবাসে না।

ভালো থেকো রাজকুমারী। আমি আজকাল অনেক ভালো আছি, ঠিক শেষ বিকেলে নীড়হারা পাখিরা যেমন ভালো থাকে।

আর শোনো, রাস্তা পার হওয়ার সময় একদম তাড়াহুড়া করবে না। বাইরে যাওয়ার সময় অবশ্যই চশমাটা সঙ্গে নেবে। সবকিছুর জন্য সরি রাজকুমারী!

ইতি,
তোমার কেউ না

 বিদায়ের শেষ স্মৃতি

কত না আশা ছিল এই মাটির বুকে সুখের ঘর বাঁধব। মুক্ত স্বাধীন বলাকার মতো ভেসে সন্ধ্যার নীড়ে আবার এক হব। তা আর হলো না। মিলনের মালাগাঁথা শেষ হলো না। সুখের হাওয়া সইল না আর আমার জীবনে। এত দিন শুধু স্বপ্নের বালুচরে বেঁধেছিলাম বাসা। নিয়তির নিষ্ঠুর ঝড়ে ভেঙে গেল সেই সুখের ঘর। নীড়হারা পাখির মতো ক্লান্ত দুটি ডানা মেলে উড়ে চলেছি ওই দূর অজানা গায়ে। হয়তোবা আর দেখা হবে না কোনো দিন। ফিরে আর আসব না এই চেনা পাদপীঠে। কেউ দিল না একবিন্দু ভালোবাসা। খুঁজে পেলাম না এমন একজন মনের মানুষ, যে মুছে দেবে আমার আঁখিজল। তুমি সুখী হও, শান্তিতে থেকো। বিদায়ী আশীর্বাদ ছাড়া তোমাকে দেওয়ার মতো আর কিছুই বাকি নেই। শূন্য বুকে আছে শুধু বেদনার তুমুল ঝড়। দুঃখের আগুনে জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে গেছে আমার এই অন্তর। তাই শুধু চোখের জলে বেদনার কালি দিয়ে অমর করে রেখে গেলাম এটুকু।

সিয়াম বিন আহমাদ
ইসলামী বিশ্যবিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

 লেখা পাঠানোর ঠিকানা

অধুনা, প্রথম আলো, সিএ ভবন, ১০০ কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫।

ই-মেইল: [email protected] ফেসবুক: facebook.com/adhuna.PA. খামের ওপর ও ই-মেইলের subject-এ লিখুন ‘মনের বাক্স’