মনে রেখো ফিরে আসার পথটা খুব সহজ
মার্কিন সংগীতশিল্পী জন লেজেন্ড ২০১৫ সালে সেলমা ছবির গ্লোরি গানের জন্য অস্কার জেতেন। তাঁর ঝুলিতে সংগীতজগতের সবচেয়ে সম্মানজনক গ্র্যামি পুরস্কার আছে ১১টি। গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক ইউনিভার্সিটির সমাবর্তনে বক্তৃতা দেন তিনি।
ভাবা যায়, আজ ১৪ মাস পর আমি জলজ্যান্ত শ্রোতাদের সামনে দাঁড়ানোর সুযোগ পেলাম! গত বছরের ফেব্রুয়ারির পর আজই প্রথমবারের মতো করতালির আওয়াজ শুনলাম। আমার মতো একজন পারফরমারের জন্য এটা এক বিরাট ব্যাপার! মঞ্চে ফিরতে পেরে ভীষণ ভালো লাগছে।
তবে এই চোখ ধাঁধানো ক্যাম্পাসে এটাই আমার প্রথম আসা নয়। ২০০৪ সালে এখানে এসেছিলাম কানিয়া ওয়েস্টের সঙ্গে, তাঁর পিয়ানোবাদক হিসেবে। এরপর থেকে আমি কানিয়ার জন্য বাজাতাম, আর গানের প্রয়োজনে কোরাস অংশে কণ্ঠ দিতাম। মনে মনে খুব চাইতাম, কেউ আমাকে একটুর জন্য হলেও যদি খেয়াল করত! সৌভাগ্যবশত সে বছরই আমার প্রথম অ্যালবাম ‘গেট লিফটেড’ মুক্তি পায়। আজ মনে হচ্ছে, হয়তো এই ক্যাম্পাস থেকেই আমার ভাগ্যবদল শুরু হয়।
কী পেলে, কী হারালে
বিশ্বাস করো, এটা তোমাদের জীবনের অন্যতম বিশেষ একটা দিন। অবশ্য এটা উপলব্ধি করতে না পারলেও কোনো সমস্যা নেই। ১৯৯৯ সালে আমি যখন আমার সমাবর্তনের জন্য তৈরি হচ্ছিলাম, আমিও এই দিনের বিশেষত্ব বুঝতে পারিনি। কিন্তু যখন আমি মূল অনুষ্ঠানে ঢুকলাম, আমার পরিবার, কাছের মানুষদের উচ্ছ্বাস দেখলাম, উপলব্ধি করলাম: সমাবর্তন নয়, এই দিনের বিশেষত্ব হলো পুনর্মিলনে, উচ্ছ্বাসে, উদ্যাপনে।
আমাকে স্বীকার করতেই হবে—তোমরা, ২০২১ সালের সমাবর্তন পাওয়া শিক্ষার্থীরা গত এক বছরে অনেক কিছু হারিয়ে আজ এ পর্যন্ত এসেছ। তোমাদের মধ্যে কেউ হয়তো চাকরি হারিয়েছ, কেউ হারিয়েছ কাছের মানুষ। আর গড়পড়তায় সবাই হারিয়েছ ছাত্রজীবনের অমূল্য একটি বছর। আরও হারিয়েছ ক্যাম্পাসে কাটানো ছোট ছোট মহামূল্যবান অসংখ্য মুহূর্ত।
হ্যাঁ, তোমাদের কষ্ট আমি কিছুটা হলেও বুঝতে পারছি। তোমরা এমন কিছু সময়, এমন কিছু স্মৃতি হারিয়েছ, যা কোনোভাবেই আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। মিষ্টি কথা দিয়ে তোমাদের সেই কষ্ট আমি ঘোচাতে পারব না।
কিন্তু এত অমূল্য মুহূর্ত হারালেও তোমাদের কিছু বিশেষ অর্জন রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, তোমাদের ভেতরের প্রতিযোগিতার মনোভাব, লড়াই চালিয়ে যাওয়ার স্পৃহা। এত প্রতিকূলতার পরও তোমরা বিশ্বের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাবর্তন নিচ্ছ, এটাই হলো দৃঢ় প্রতিযোগিতাসম্পন্ন মনোভাবের লক্ষণ।
যে কর্তব্য সবার
আমাদের সবারই এই সময়টায় থেমে যেতে হয়েছে। দূরত্ব বাড়াতে হয়েছে। মুখ ঢাকতে হয়েছে। কর্মক্ষমতা কমিয়ে আনতে হয়েছে। নিজের যত্ন নিতে হয়েছে। শুধু নিজের জন্য নয়, এসবই করতে হয়েছে চারপাশের মানুষের সুস্থতার জন্য। কারণ, গত এক বছরে আমরা শিখে গেছি, বর্তমান বাস্তবতা হলো: নিজেকে সুস্থ রাখাতেই সবার নিরাপত্তা নির্ভর করছে। আর সবাই নিরাপদ থাকলে আমরা নিজেরা থাকব ঝুঁকিমুক্ত। এই যে একে অপরের কথা ভেবে কিছু করার মনোভাব, এটাই আমাদের গত এক বছরের অন্যতম অর্জন।
তোমাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো ভাবছ, ‘আমাদের সমাবর্তনে এসে এই লোক এত কথা বলছে কেন? থামছে না কেন?’ সত্যি বলি, তোমাদের এমন প্রশ্নে আমি একদমই অবাক হচ্ছি না। কারণ, এই প্রশ্ন প্রথমবার শুনছি, তা নয়। আমার সংগীতজীবনের শুরু থেকেই শুনে আসছি, ‘বেশি কথা বোলো না। চুপচাপ শুধু গানটাই গাও।’
কিন্তু তোমরা কি জানো, নর্থ ক্যারোলিনার নিনা সিমল কী বলে গেছেন? তিনি বলেছেন, ‘শিল্পীর কর্তব্য হলো সমাজের প্রতিচ্ছবিকে সবার সামনে তুলে ধরা।’
এই কর্তব্য শুধু শিল্পীর নয়। এটা একজন ব্যাংকারেরও দায়িত্ব। একজন আইনজীবীরও। এই দায়িত্ব একজন চিকিৎসক, একজন শিক্ষক, প্রকৌশলী, উদ্যোক্তা, সাংবাদিক, রাজমিস্ত্রি, নার্স, একজন মা, একজন বাবারও। প্রশ্ন করতে পারো, তাহলে আমরা কোথা থেকে সমাজের সংস্কারের কাজ শুরু করব? কীভাবে তুলে ধরব সমাজের প্রতিচ্ছবি? প্রশ্নটা কঠিন।
আমি তখন হাইস্কুলে পড়ি। ‘কৃষ্ণাঙ্গদের ইতিহাস’ নামে একটি রচনা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম। আমার রচনার বিষয় ছিল: ‘তুমি কীভাবে কৃষ্ণাঙ্গদের ইতিহাসে অবদান রাখবে?’
সেই সময় আমি আমার ১৫ বছর বয়সের আত্মবিশ্বাস থেকেই লিখে দিয়েছিলাম, ‘আমি বিখ্যাত সংগীতশিল্পী হব। আর এভাবেই নিজেকে এমন জায়গায় নিয়ে যাব, যেখান থেকে কথা বললে আমার বক্তব্য সমাজে প্রভাব ফেলবে। তখন আমি আমার কথা ও কাজ দিয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের অগ্রযাত্রায় অবদান রাখব।’
কিন্তু নিজেকে ওই অবস্থানে আমি নেব কী করে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাকে অনেক ভাবতে হলো। প্রায় এক দশক নানা চেষ্টা, সংগ্রাম ও অধ্যবসায়ের পর এই প্রশ্নের তিনটি উত্তর আমি খুঁজে পেলাম।
১. শেখার কোনো শেষ নেই
শেখার বয়স কখনো ফুরায় না। তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়জীবন আজ এখানে শেষ হতে পারে। কিন্তু এটাই শেখার শেষ নয়। আমি যদি নিজের সমাবর্তনের পরই নিজেকে শিক্ষিত ভেবে শেখার আগ্রহে ইতি টেনে দিতাম, তাহলে হয়তো তোমাদের সামনে দাঁড়াতে পারতাম না। তাহলে হয়তো আজ আমার অর্জনের খাতা শূন্য থাকত। আমৃত্যু শেখার আগ্রহ তোমাদের যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে লড়াই করার শক্তি দেবে।
যখনই মনে হবে সমস্যার বেড়াজালে জড়িয়ে হারিয়ে যাচ্ছ, মনে রেখো ফিরে আসার পথটা কিন্তু খুব সহজ। আর এই পথের ধ্রুবতারা হলো ভালোবাসা। ভালোবাসাই তোমাকে সব জটিলতা থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখাবে। এই কথাগুলো গানের মতো শোনাতে পারে, মনে হতে পারে কাব্যিক। কিন্তু আমি আমার সবটুকু বিশ্বাস আর জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এটা চিরন্তন সত্য।
২. বড় হওয়ার আগে, বাড়ির দিকে দেখো
ইংরেজিতে আমরা বলি, ‘গো বিগ অর গো হোম’। অর্থাৎ ‘হয় বড় হও, অথবা বাড়ি যাও’। তবে আমার অভিজ্ঞতা বলে বড় হওয়ার আগে বা বড় হওয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা বাড়ি থেকেই শুরু করা উচিত। সেটা যে কাজই হোক না কেন।
আমরা অনেক সময় বিরাট বিরাট জাতীয় ইস্যু নিয়ে উত্তেজিত হয়ে যাই। আমি বলছি না যে জাতীয় ইস্যু নিয়ে উত্তেজিত হওয়া যাবে না। কিন্তু এরও আগে আমাদের ভাবতে হবে আমার নিজের শহরের উন্নয়ন নিয়ে, নিজের এলাকা নিয়ে, স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে। কে আমার এলাকার প্রতিনিধি? এলাকার স্কুলটার কী অবস্থা? পাশের বাড়ির পরিবারটা কেমন আছে? এলাকার রাস্তায় হাঁটা কতটা নিরাপদ? আমার বাড়ির চারপাশের এই বিষয়গুলোতেই কিন্তু নির্ভর করে আমার নিজের ভালো থাকা।
আমি জানি, সমাবর্তনের পর তোমরা একেকজন একেক শহরে গিয়ে কর্মজীবন শুরু করবে। আশা করব, তোমরা সেই শহরে গিয়ে তার অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎটা জেনে নেবে। আশা করব নিজের মেধা আর মনন দিয়ে ওই শহরের উন্নয়নে নিজেকে নিয়োজিত করবে। মনে রাখবে, স্থানীয় উন্নয়নই কিন্তু দেশের সামগ্রিক উন্নতিতে প্রভাব ফেলবে।
৩. এগিয়ে যাও ভালোবেসে
যখনই মনে হবে সমস্যার বেড়াজালে জড়িয়ে হারিয়ে যাচ্ছ, মনে রেখো ফিরে আসার পথটা কিন্তু খুব সহজ। আর এই পথের ধ্রুবতারা হলো ভালোবাসা। ভালোবাসাই তোমাকে সব জটিলতা থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখাবে। এই কথাগুলো গানের মতো শোনাতে পারে, মনে হতে পারে কাব্যিক। কিন্তু আমি আমার সবটুকু বিশ্বাস আর জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এটা চিরন্তন সত্য।
অস্ট্রীয় সমাজকর্মী লিলা ওয়াটসনের একটি বক্তব্যের রেশ ধরে বলছি, ভালোবাসা মানে হলো তোমার স্বাধীনতার সঙ্গে আমার স্বাধীনতা জুড়ে দেওয়া। আর আমারটার সঙ্গে তোমারটা। আবার গণমানুষের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে অধ্যাপক কর্নেল ওয়েস্টের একটা ব্যাখ্যা আছে, তা হলো ন্যায়ের চর্চা করাকেই বলা হয় গণমানুষের প্রতি ভালোবাসা।
ভালোবাসো তোমার পরিবারকে, বাড়ির পাশের প্রতিবেশীদের। ভালোবাসো গণমানুষকে। এভাবেই আমরা এখনকার সংকটময় সময় উতরে যাব। (সংক্ষেপিত)