মাকে ছাড়া প্রথম ঈদ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘প্রতিটি ঈদে আগে থেকেই মায়ের প্রস্তুতি শুরু হতো। জানালা-দরজার পর্দা থেকে পুরো ঘর পরিষ্কার করতেন। কিন্তু এবার সব থমকে গেছে। মা নেই। ঈদও নেই।’ সম্প্রতি মা হারানো ক্রীড়া সাংবাদিক নাইর ইকবালের সঙ্গে কথা হচ্ছিল ঈদুল আজহার দুদিন পর। মাকে ছাড়া তাঁর এবারের ঈদ ছিল বিষণ্ন, স্মৃতিতে ভারাক্রান্ত। থমকে যাওয়া ঈদের আনন্দ নিয়ে নাইর ইকবাল তাই বলেন, ‘শৈশব থেকে আমাদের ভাইবোনদের ঈদের দিন মা সাজিয়ে-গুছিয়ে দিতেন। ঈদের আনন্দ আর মায়ের আদরের সমন্বয় ছিল। সেই সমন্বয়ে এখন শুধু শূন্যতা। মা ছাড়া দিন শুরু হয়েছে। ঈদ চলে গেছে। ঘর-মন শূন্য করা এমন ঈদ আর কারও জীবনে না আসুক।’

এমনই বিষণ্ন, শোকস্মৃতির প্রথম ঈদ কাটিয়েছেন অনেক সন্তান। করোনাকালে মৃত্যুর মিছিলে শামিল হয়েছেন অনেকের মা। অসুস্থতা, দুর্ঘটনায় কিংবা স্বাভাবিক মৃত্যুও হয়েছে অনেকের মায়ের। আকাশের তারা হয়ে যাওয়া সেই মায়েদের নাড়িছেঁড়া সন্তানেরা এই প্রথম বুঝলেন ঈদ মানে আনন্দ নয়, বেদনাময় একটি দিন। ঈদের প্রস্তুতির সবকিছুতে যেখানে মায়ের তদারকি থাকে, এখন মা নেই বলে ঈদ এসেছে করুণ সুরে। তাই এবার অনেক সন্তানের কাছে ছিল শূন্যতায় ভরা ঈদ।

বেসরকারি টিভি চ্যানেল নিউজ টোয়েন্টিফোরের বার্তা সম্পাদক বোরহানুল হক সম্রাট ঈদের কয়েক দিন আগে মা-বাবা দুজনকেই হারান। শোকে মুহ্যমান বোরহানুল হক বলেন, ‘মা ছাড়া ঈদ মানে এক অসহনীয় জীবনের পথে বাধ্য হয়ে হাঁটতে থাকা। মায়ের সঙ্গে কাটানো সময়ের পরিমাণ যত বেশি, ততই তা নানাভাবে ফিরে আসতে থাকে। আর ঈদ বলেই এবার হাজার গুণ হাহাকার নিয়ে তা আমাদের পুরো পরিবারে ছড়িয়ে পড়েছে।’ ঈদের নামাজে যাওয়ার সময় চোখে সুরমা লাগানো আর ফিরে এসে প্রথমেই মাকে সালাম করা আর হয়তো হবে না তাঁর। তাই তো বোরহানুল হক বলেন, ‘আসলে হঠাৎ করে মা না থাকা ঈদ মানে শূন্য হয়ে পড়া কিছু সময়, যা পূরণ করার কোনো পথ থাকে না। আমরা তো শত কষ্ট করে ঈদে বাড়ি যাই মায়ের মুখের একটু হাসি দেখার জন্য। মা-বাবা না থাকায় সেই টান আর কোনো দিন অনুভব করব কি না, জানি না।’

ব্যাংক কর্মকর্তা রওশন আরা ঈদুল ফিতর করেছেন শ্বশুরবাড়িতে। কথা ছিল ঈদুল আজহা করবেন ময়মনসিংহে মায়ের সঙ্গে। কিন্তু তাঁর মা সবাইকে ফেলে চলে গেছেন! ঈদের ২০ দিন আগে ব্রেন স্ট্রোকে মারা যান রওশন আরার মা। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে অদ্ভুত লাগে। কীভাবে সম্ভব? ঈদে সবকিছু আছে, কিন্তু আমার মা নেই। গরু কেনা থেকে শুরু করে মাংস বণ্টন, ঝুরা মাংস দিয়ে গরম ভাত আমার মুখে তুলে খাইয়ে দেওয়া, আমি কোথায় পাব?’ প্রশ্ন করেন বটে, উত্তর মেলে না। তাই কথা আর বেশি দূর এগোয় না। ঝরঝর করে কাঁদতে থাকেন রওশন আরা।

ঈদের ঠিক দুদিন আগে মারা যান সাংবাদিক হাবিবুল্লাহ সিদ্দিকের মা। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সামনে দিনের পর দিন মায়ের জন্য প্রার্থনা করেও ফিরে পেলেন না মাকে। তাই ঈদ এল নিরানন্দ নিয়ে। তিনি বলেন, ‘এবারের ঈদের মতো ভয়ংকর ঈদ আমার জীবনে ছিল না, আর আসবেও না। জীবনের কী অমূল্য সম্পদ হারিয়েছি আমরা ভাইবোনরাই বুঝেছি। আমার মায়ের সঙ্গে তো আর ঈদ আমি পাব না।’ কথা শেষ করার আগেই গলা ধরে আসে হাবিবুল্লাহ সিদ্দিকের।

একই শহরে থাকতেন শারমীন ইতি এবং তাঁর মা। শুক্রবার হলেই মায়ের বাসায় চলে যাওয়া। ছেলে–মেয়ে, মা–বাবাকে নিয়ে হুল্লোড় করে ছুটির দিন কাটানো। কিন্তু সম্প্রতি করোনা এবং ব্রেন স্ট্রোকে অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে মা–বাবা দুজনকেই হারান তিনি। শারমীন ইতি বলেন, ‘আসলে মা ছাড়া ঈদ কেমন, তা মাহারা সন্তান মাত্রই বুঝতে পারবে। কী আগলে, যত্ন করে সাজিয়ে–গুছিয়ে দিতেন ঈদের দিন আম্মা। বিয়ের পর সকালে প্রথম ফোন আসত আম্মার। যেন আমার মন খারাপ না থাকে। আম্মা চলে যাওয়ার পর শূন্যতা ছিল। হাহাকার ছিল। কিন্তু প্রথমবার মাকে ছাড়া ঈদ করতে গিয়ে বুঝলাম কতটা অসহায় আমি।’