মাতৃত্বের স্বাদ না পাওয়াই কি অপূর্ণতা

সেদিন মৌমিতাদের বাড়ি গিয়েছিল পাপিয়া ওদের নেমন্তন্ন করতে। পাপিয়াদের বাড়িতে কোনো উৎসব, অনুষ্ঠান বা পার্টি হলে অতিথি তালিকায় মৌমিতারা থাকেই। ওদের সঙ্গে একটা আত্মীয়তা তো আছেই, তার ওপর ওরা পাপিয়াদের ভালো বন্ধু।

এবার নেমন্তন্ন পেয়ে মৌমিতার কোনো রকম উচ্ছ্বাস দেখা গেল না। বরং একটু ইতস্তত ভাব দেখা গেল। পাপিয়া একটু অবাকই হয়ে বলে—অন্য কোনো প্রোগ্রাম আছে নাকি? বাতিল করে দাও, তোমরা না এলে হবে না কিন্তু।

মৌমিতার বর শিশির বলে ওঠে—আরে না না, আমরা সকাল সকাল পৌঁছে যাব। মিয়া উৎসাহ দেখালেও বিবি কিছু বলে না। পরে চা পান করতে করতে মৃদু গলায় জানতে চাইল মৌমিতা—সেদিন কি মেজ চাচিও নিমন্ত্রিত? তক্ষুনি বুঝতে পারল পাপিয়া, মৌমিতার অস্বস্তিটা কোথায়? মেজ চাচি মানুষটা এমনিতে হাসি–খুশি, অমায়িক। কিন্তু সব সময় ভেবেচিন্তে কথাবার্তা বলেন না।

শিশির–মৌমিতার বিয়ে হয়ে গেছে নয় বছর, এখনো ওদের কোনো সন্তান নেই। দুজন দুজনকে নিয়ে খুবই পরিতৃপ্ত। যথেষ্ট প্রেম ওদের দাম্পত্যে। ওদের দাম্পত্য সুখ দেখে কখনো সন্তানহীনতা নিয়ে প্রশ্ন করার কথা মাথাতেই আসেনি। কিন্তু মেজ চাচির মুখের কোনো আগল নেই। নেমন্তন্ন বাড়ির এক ঘর লোকের সামনেই হয়তো বলে ফেলবেন, আর কত দিন টোনা–টুনি হয়ে থাকবে। এবার একটা ছেলে–পুলে আনো। আমরাও নাতি–নাতনির মুখ দেখে যাই। এ রকম একবার নয়, বহুবার হয়েছে। মেজ চাচি মৌমিতারও সম্পর্কে আত্মীয়, তাই প্রায় অনুষ্ঠানে দেখা হয়। আর যতবারই মৌমিতা আর চাচি মুখোমুখি হয়েছে ততবারই। কখনো আবার তুলনাও চলে এসেছে—এই তো তোমারই বন্ধু নীতা ও চন্দনের কেমন ছেলেমেয়ে নিয়ে ভরা সংসার। পাপিয়াদের প্রসঙ্গও এসেছে দু–একবার। মৌমিতার টকটকে লাল হয়ে যাওয়া মুখ দেখে পাপিয়ার ভীষণ কষ্ট হয়েছে আর রাগও হয়েছে মেজ চাচির ওপর। মৌমিতা তাই স্বভাবতই মেজ চাচিমাকে এড়িয়ে যেতে চায়। পাপিয়া ওকে আশ্বস্ত করে যে মেজ চাচিমা এবার নিমন্ত্রিতের তালিকায় নেই।

মৌমিতার কাছে সেদিন জানতে পারে পাপিয়া, বিয়ের নয় বছর পর ও এখন অন্তঃসত্ত্বা। তবে এ ব্যাপারে ঢাক পেটানোর কোনো কারণই ওরা দেখছে না। বিয়ের তিন–চার বছর ওরা সন্তানের কথা চিন্তাই করেনি। কিন্তু যখন সন্তান নেওয়ার কথা চিন্তা করল, তখন তা আসতে দেরি হলো। দুজনেই কর্মব্যস্ত। সন্তানহীনতার জন্য হা–হুতাশ করার সময় কই? তাহলে তৃতীয় ব্যক্তি বা এই ব্যাপারে ওদের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করবে কেন?

তবে এই ধরনের চাপ যে সব সময় বয়স্কদের দিক থেকে আসে, তা নয়। বন্ধুদের মধ্যে তাপসী আর রোহানের বিয়ে হয়েছিল সবচেয়ে আগে। বিয়ের পরেও ওদের বাড়িতে হরদমই গেট টুগেদার আর আড্ডা লেগেই থাকত। ধীরে ধীরে বিয়ে হয়ে গেল ওদের দলের সবারই। তারপর একজন একজন করে মা–বাবা হয়ে গেল।

তাপসী আর রোহানের কিন্তু এখনো কোনো সন্তান হয়নি। বন্ধুরা যে যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত, দেখা–সাক্ষাৎও কম হয়। তবু বছরে একবার শীতকালে তাপসীদের বাগানের বারবিকিউটা এখনো বজায় আছে। সেদিন সব বন্ধু ওখানে জড়ো হয়। দুই বছর ধরে পাপিয়া লক্ষ করে সোমা আর তনিমা যখনই মৌমিতার সঙ্গে কথা বলে তখন স্বরে, দৃষ্টিতে করুণা মাখানো। সোমা একদিন পাপিয়াকে বলে—মৌমিতাদের এখানে এত আসতে ইচ্ছা করে, কিন্তু আসতে পারি না। তাতানকে কোথায় রেখে আসব? পাপিয়া বলে, ‘রেখে আসবি কেন, নিয়েই আসবি।’ সোমা মৃদু স্বরে বলে, ‘আমার খুব খারাপ লাগে, ওদের তো এখনো কিছু...।’ পাপিয়া হতবাক হয়ে যায়। পাপিয়া জানে মৌমিতা–শিশির সন্তান আনেনি নিজেদের ইচ্ছায়। ওরা দুজনেই এমন পেশায় রয়েছে, বাড়িতে সময় দিতে পারে খুবই কম। দুজনের পেশাই দুজনের খুব প্রিয়। ওরা জানে বাড়িতে যেটুকু সময় কাটতে পারে, তা যথেষ্ট নয়। সন্তানকে বড় করে তুলতে যে অনেক ভালোবাসা অনেক মনোযোগ আর সময়ের প্রয়োজন। অতটা সময় যখন ওদের হাতে নেই, তখন ওরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেয় যে এখন সন্তান আনবে না। এর মধ্যে দুঃখের ব্যাপারই নেই।

তনিমার প্রতিক্রিয়াও কম অদ্ভুত নয়। অন্য যাবতীয় আলোচনা বাদ দিয়ে দেখা হলেই মৌমিতাকে এখন সে শুধু তার ছেলেমেয়ের গল্প শোনায়। ওর ধারণা, বাচ্চাদের গল্প শুনলে মৌমিতার মা হওয়ার ইচ্ছা হবে। ওরা আধুনিক যুগের মেয়ে—কারও যে অন্য রকম ইচ্ছা হতে পারে, এটা বুঝতে ওদের কেন যে এত অসুবিধা, বুঝতে পারে না পাপিয়া।

বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন তো আছেই, চিকিৎসকেরাও এ ব্যাপারে চাপ দিতে পারে। যেমন হয়েছে রিয়া ও মুহিতের। ওরা দুজনেই চিকিৎসক। বিয়ের চার–পাঁচ বছরেও সন্তান না আসায় ওরা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়। দুজনের কারও বাড়ি থেকেই কোনো রকম চাপ ছিল না। কিন্তু নিজেরা ডাক্তার হওয়ায় ওরা জানত সন্তান ধারণ করতে হলে একটা বয়সের মধ্যেই করা উচিত। তাই ওরা সময়মতো চিকিৎসক দেখাল। দুজনের মধ্যেই কিছু কিছু শারীরিক অসুবিধা পাওয়া গেল। ডাক্তার চিকিৎসায় লেগে গেলেন। মুহিতের ব্যাপারটা সেরে গেলেও রিয়ার চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি হলো। ডাক্তারবাবু এবার ওদের বোঝাতে শুরু করলেন, টেস্ট টিউব বেবির বিষয়ে। নানাভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করলেন ওদের। তিনি ধরেই নিলেন, যেকোনোভাবে ওদের সন্তান চাই। ওরা দুজন কিন্তু ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল। সাধারণ চিকিৎসার পর যদি সন্তান আসে তো খুবই ভালো, কিন্তু তা না হলে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা টেস্ট টিউব বেবিজাতীয় জটিল পদ্ধতিতে ওরা যাবেই না। সে ক্ষেত্রে একটি শিশুকে দত্তক নেওয়ার ইচ্ছা রয়েছে ওদের।

আসলে বিয়ে হয়েছে অথচ কোনো দিন সন্তান চায় না—এমন মানুষ বিশেষত মেয়েদের আজও অনেকে অস্বাভাবিক মনে করে। পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় এনে ফেলে নারী আজ মহাকাশে পাড়ি জমিয়েছে। তবু মাতৃত্বের স্বাদ না পাওয়া পর্যন্ত তাকে পরিপূর্ণা বলে মেনে নেয় না কেউ।