মানুষেরা বলত, আমরা মানিকজোড়

বন্ধু কাজী আমির হোসেনের শেষবিদায়ের আনুষ্ঠানিকতায় হাজির হয়েছিলেন সুধীর চন্দ্র দাশ। জানাজার সময় পাশে বসে কাঁদছিলেন তিনি। সুধীর চন্দ্র দাশের শোকাতুর সেই মুহূর্তের ছবিটি গত মাসের শুরুতে ছড়িয়ে পড়েছিল ফেসবুকে। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার চাপাচৌ গ্রামের সুধীর চন্দ্র দাশ লিখেছেন তাঁর প্রয়াত বন্ধুকে নিয়ে

সুধীর চন্দ্র দাশ

বন্ধু তো একই মনের দুটি মানুষ। কাজী আমির হোসেন আমার তেমনই বন্ধু। আমাদের বাড়ি একই গ্রামে। প্রথম শ্রেণিতে আমরা একই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। তারপর কখন যে বন্ধু হয়েছি, নিজেরাও জানি না। ধর্মে দুজনের মধ্যে পার্থক্য কোনো দিন অনুভব করিনি। দুজনেই একে অন্যের বিপদে-আপদে, সুখে-দুঃখে এগিয়ে যেতাম। হাটবাজারে একসঙ্গে যাওয়া হতো। দুজনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও একই বাজারে ছিল। গ্রামের বিচার-আচারও চলত একসঙ্গে। বিচারে ন্যায্য কথা বলতাম দুজনে।

পাড়া-মহল্লা-গ্রামজুড়ে এ নিয়ে আমাদের বেশ পরিচিতি ছিল। এলাকার মানুষ আমাদের সমীহ করতেন। সম্মান করতেন। ঈদের সময় আমিরের বাড়িতে আমাদের পুরো পরিবার বেড়াতে যেত। শারদীয় দুর্গাপূজায় আমিরও পুরো পরিবার নিয়ে আমার বাড়িতে আসতেন। এ ছাড়া বছরের অন্য সময়ে যেকোনো অনুষ্ঠান হলে আমরা একসঙ্গে জড়ো হতাম।

গত সেপ্টেম্বরে বন্ধু কাজী আমির হোসেনের শেষ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতায় সুধীর চন্দ্র দাশ। এই ছবিটি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিল
ছবি: সংগৃহীত

এমন কত কথা বলতে পারি আমাদের বন্ধুত্ব বোঝাতে। কিন্তু আমার প্রিয় বন্ধু আর নেই। গত ৭ সেপ্টেম্বর তাঁকে হারিয়েছি। তাঁকে হারানোর কথা আমি এখনো ভাবতেও পারি না। ওর জানাজার সময় কাঠের গুঁড়ির ওপর বসে ছিলাম। শেষবিদায়ে স্বাভাবিকভাবে আমি ভেঙে পড়েছিলাম, কাঁদছিলাম। কে ছবি তুলেছিল, জানি না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমার কান্নার এই ছবি ছড়িয়ে পড়লে বহু লোক আমাকে দেখতে আসে।

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার গুণবতী ইউনিয়নের চাপা গ্রামে বন্ধু কাজী আমির হোসেনের বাড়ি। মানুষ তাঁকে আমির সওদাগর নামে ডাকত। গুণবতী বাজারে একসঙ্গে ব্যবসা করতাম আমির ও আমি। পাশাপাশি দোকান ছিল। দুজনের প্রয়োজনে লেনদেন করতে হয়েছে। কিন্তু কোনো দিন অর্থ নিয়ে মনোমালিন্য হয়নি। শারীরিক অসুস্থতার কারণে বছর সাতেক আগে আমি ব্যবসা গুটিয়ে নিই। ব্যবসা গুটিয়ে নিলেও আমিরের দোকানে নিয়মিত যাতায়াত ছিল আমার। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতো, যেন গল্প শেষ হতো না আমাদের। বাজারের মানুষ বলতেন, আমরা মানিকজোড়।

আমির হোসেনকে হারানোর পর আমি আর বের হই না। কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না। কারও সঙ্গে মিশতেও ভালো লাগে না। দীর্ঘ জীবন একসঙ্গে ঘুরেছি। দুজনের বোঝাপড়া ছিল, মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই আমরা বুঝতাম। শেষ বয়সে নিজেকে ভীষণ অসহায় বোধ হয়। এখন আমার বয়স ৭৬ বছর। তাঁর আগে আমারই চলে যাওয়া দরকার ছিল। তাঁকে ছাড়া আমার কিচ্ছু ভাল্লাগে না। এখনো গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে তাঁর জন্য কেঁদে উঠি। মনে হয়, তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে গেলেই পারতেন।

আপন ভাইয়ের মতো আমাকে আগলে রেখেছিলেন আমির। আমাদের সন্তানেরাও আমাদের বন্ধুত্বকে সম্মান করে। আমি চলে যাওয়ার পরও যেন ওদের সম্পর্কটা থাকে, এটা আমার সন্তানদের বলেছি। আজকাল কত কিছু হয়। ধর্ম নিয়ে কথা বলে। আমি বলি মানবধর্ম বড়। মানবের জন্য কাজ করাই আসল।

অনুলিখন: গাজীউল হক