মানুষের রিভিউ

পত্রিকা, ম্যাগাজিন বিশেষ করে ফেসবুকে আমরা প্রতিদিনই বিভিন্ন জিনিসের রিভিউ দেখি। মুভি রিভিউ, বুক রিভিউ, ফুড রিভিউ, অ্যাপস রিভিউসহ আরও কত কিছু। কিন্তু জলজ্যান্ত মানুষের রিভিউ কেউ লেখে না। লিখলে কেমন হতো বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের রিভিউ? দেখাচ্ছেন সোহাইল রহমান
এঁকেছেন শিখা

.
.

কাজের বুয়া
নাম: কুলসুমের মা
ক্যাটাগরি: ছুটা
রিভিউ: বাসাবাড়ির সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিত্ব ছুটা কাজের বুয়া কুলসুমের মা। তাঁর চাহিদা এতটাই বেশি যে আপনি মাঝেমধ্যে নিজেই দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে যাবেন যে বাসার মালিক তিনি নাকি আপনি! প্রতিদিন সকালে অপেক্ষা করতে করতে নিজেই প্রায় অর্ধেক কাজ শেষ করে ফেলার পর আপনি যখন ভাববেন যে আজ বোধ হয় তিনি আসবেন না, ঠিক তখনই আপনার সামনে উদয় হবেন কুলসুমের মা। আর ঘরে ঢুকেই প্রথম যে কথাটা তিনি বলবেন সেটা হলো, ‘আইজকা একটু তাড়াতাড়ি ছুটি দেওন লাগব। বাড়িত মেহমান আইছে বা শরীলডা ভালা না।’ তবে সুবিধাও কম না। কুলসুমের মা ছুটা বুয়ার বাইরেও একজন সাংবাদিক এবং তাঁর কাছ থেকে আপনি পুরো এলাকার সমস্ত সংবাদ ঘরে বসেই পেয়ে যাবেন। যেমন কার মেয়ে কার ছেলের সঙ্গে প্রেম করে, কোন ভাবি তাঁর বরের সঙ্গে কী নিয়ে ঝগড়া করে বাপের বাড়ি চলে গেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে কুলসুমের মায়ের বাংলা সিনেমা আর ভারতীয় টিভি সিরিয়ালের ওপর একটু দুর্বলতা আছে। টিভিতে এগুলো চলার সময় কাজ বাদ দিয়ে সেদিকেই মনোযোগ দিয়ে ফেলেন বেশি। তারপরও যেমনই হোক, কুলসুমের মাকে আপনার লাগবেই। অতএব, ঘরের অধিকাংশ কাজ নিজে করার অভিজ্ঞতা থাকলে এবং আপনার মেজাজ যদি অত্যন্ত শান্ত হয়, তাহলে বাসার ছুটা কাজের বুয়া হিসেবে নিতে পারেন কুলসুমের মাকে।
বাসার মালিকদের রেটিং: ৫.৫/১০
আমাদের রেটিং: ৬.৭/১০

.
.

রিকশাওয়ালা
নাম: রমিজ মিয়া
রিকশার নাম: শেফালী পরিবহন
পাওয়া যাবে: ঢাকা শহরের যেকোনো ব্যস্ত রাস্তায়
রিভিউ: রমিজ মিয়ার সবচেয়ে বড় গুণ বা দোষ, যেটাই বলুন না কেন সেটা হলো তিনি রিকশা চালান নিজের মর্জিতে, টাকার জন্য নয়। মাঝেমধ্যেই তিনি রাস্তার পাশে রিকশা দাঁড় করিয়ে রেখে সিটে হেলান দিয়ে বসে চা খেতে খেতে গভীর চিন্তায় মগ্ন হন।
এ সময়ে আপনি তাঁকে কোথাও নিয়ে যেতে বললে তিনি উদাস গলায় বলবেন, ‘যামু না!’ তবে মুড ভালো থাকলে রমিজ মিয়া আপনাকে তাঁর রিকশায় ওঠাবেন এবং আপনি তাঁর রিকশায় উঠবেন মানে ঠিক যেন কোনো গানের অনুষ্ঠানের অতিথির আসন গ্রহণ করবেন। রমিজ মিয়া আপনাকে একটার পর একটা বাংলা সিনেমার গান শোনাতে থাকবে এবং সে জন্য আপনাকে কোনো অতিরিক্ত ভাড়া দিতে হবে না। কিন্তু গান গাওয়ার সময় তিনি খুব ধীরগতিতে রিকশা চালাবেন এবং আপনি দ্রুত চালাতে বললে তিনি থাকবেন নির্বিকার। তবে তাঁর গলায় সুর আছে এবং গান বেশ ভালোই গান। পরিশেষে এটুকু বলা যায় যে আপনি যদি একজন সংগীতপ্রেমী হন এবং খুব বেশি ব্যস্ততা না থাকে, তাহলে উঠতে পারেন রমিজ মিয়ার রিকশায়।
রেটিং: ৩/১০
আমাদের রেটিং: ৫/১০

.
.

বাড়িওয়ালা
নাম: আমজাদ হক
বাড়ির নাম: পিংকি ভিলা
রিভিউ: আপনি ভাড়াটিয়া হিসেবে আমজাদ হকের পিংকি ভিলার একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিলেন, মানে আপনি যেন শর্তের সমুদ্রে ঝাঁপ দিলেন। আমজাদ হক তাঁর বাসায় বাস করার জন্য আপনাকে অসংখ্য শর্ত দেবেন। ‘ফ্যামিলি’ হতে হবে, খুব বেশি ছোট বাচ্চা থাকা যাবে না, তিন মাসের ভাড়া অ্যাডভান্স দিতে হবে, ছাদে ওঠা যাবে না, রাত ১০টার মধ্যে বাসায় ফিরতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি এবং ইত্যাদি। তার ওপর প্রতি দুমাস পর ‘অটোমেটিক’ ভাড়া বাড়াবেন। তবে আপনি যদি সব শর্ত মেনে নেন এবং ঠিকঠাকভাবে পালন করতে পারেন, তাহলে আমজাদ হকের মতো ভালো মানুষ আর পাবেন না। প্রায়ই তাঁর বাসায় আপনার পরিবারসহ চা পানের দাওয়াত পড়বে এবং আপনাকে গেস্টরুমে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমজাদ হকের দেশ-জাতি এবং রাজনীতি-বিষয়ক নাতিদীর্ঘ পর্যালোচনা শুনতে হবে।
ভাড়াটিয়াদের দেওয়া রেটিং: ৩.৫/১০
আমাদের রেটিং: ৫/১০

.
.

রাজনীতিবিদ
নাম: শমসের আলী
ক্যাটাগরি: সুবিধাবাদী
দল: যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে
রিভিউ: শমসের আলী একজন বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ, যাঁকে আপনি আপনার এলাকায় প্রতি পাঁচ বছর পর পর দেখতে পাবেন। যিনি ভোট নামের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এক ‘জিনিসের’ আশায় আপনার বাড়িতে সকাল-সন্ধ্যা দুবার করে আসবেন। সেই সঙ্গে আপনার সমস্ত সমস্যা দূর করার আশ্বাসও দেবেন। অতঃপর নির্বাচনে জয়লাভ করার পর শমসের আলী পরিণত হবেন অদৃশ্য মানবে। তাঁর ইতিবাচক দিক হলো তিনি খুব ভালো কথা বলতে পারেন। নেতিবাচক দিক হলো তিনি কথামতো কোনো কাজই করেন না। শমসের আলীর আরেকটা বৈশিষ্ট হলো, তিনি কাউকে কখনোই ‘না’ বলেন না। আপনি যদি তাঁর কাছে গিয়ে আবেদন করেন যে ‘আমার বাসায় একটা পদ্মা সেতু বানিয়ে দিতে হবে’, তাতেও তিনি সম্মতি দিয়ে বলবেন, দ্রুতই কাজটা করে দেওয়া হবে। কিন্তু তাঁর সমস্যা হলো, তিনি খুব দ্রুত সবকিছু ভুলে যান, যেটা তাঁর রেটিংয়ে প্রভাব ফেলেছে।
এলাকার মাস্তানদের দেওয়া রেটিং: ৮/১০
সাধারণ জনতা এবং আমাদের রেটিং: ২.৫/১০

.
.

অফিসের বস
নাম: শরাফত উল্লাহ
ক্যাটাগরি: কসাই
রিভিউ: ‘বস ইজ অলওয়েজ রাইট’ নীতিতে বিশ্বাসী শরাফত উল্লাহ বস হিসেবে বেশ মেজাজি মানুষ। তিনি বিশ্বাস করেন, অফিসের কাজ ঠিকঠাকভাবে চালানোর জন্য কর্মচারীদের মাস শেষে বেতনের পাশাপাশি প্রতিদিন তিনবেলা ঝাড়ি দেওয়া খুব জরুরি। ঝাড়ির পাশাপাশি ‘না’ বলাতেও তিনি ‘সিদ্ধহস্ত’। আপনি ছুটি থেকে শুরু করে বোনাস—যা-ই চান না কেন, তিনি একবাক্যে না বলে দেবেন। এ তো গেল নেতিবাচক দিক, শরাফত উল্লাহর ইতিবাচক দিকও আছে। মনমেজাজ ভালো থাকলে তিনি আপনাকে নিজের রুমে ডেকে নিয়ে কফি খাওয়াবেন। কফি খাইয়ে কয়েকটা অতিরিক্ত ফাইল আপনার হাতে ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করবেন। আর হ্যাঁ, শরাফত উল্লাহর পছন্দের কাজ হলো চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়া। অপছন্দের কাজ হলো ওয়ার্কিং আওয়ারে অফিসের কাউকে ঘুমাতে দেখা। সবশেষে বলা যায়, ঝাড়ি যদি আপনার পছন্দের খাবার হয়, তাহলে চাকরি নিতে পারেন শরাফত উল্লাহর অফিসে।
কর্মচারীদের দেওয়া রেটিং: -২.৫/১০
আমাদের রেটিং: ৪/১০

.
.

বিক্রয়কর্মী
নাম: মাছুম
কর্মস্থল: স্বর্ণালী কাপড় বিতান
ধরন: ছেলেদের শার্ট-প্যান্ট বিক্রেতা
রিভিউ: স্বর্ণালী কাপড় বিতানে ঢুকে বিক্রয়কর্মী মাছুমের সামনে দাঁড়ালে পরবর্তী ২০ মিনিটের জন্য আপনি প্রবেশ করবেন এক ঘোরের জগতে। যেখানে মাছুম আপনাকে তাঁর কথার জালে মুগ্ধ করে ৪০০ টাকার পোশাক হাজার টাকায় গছিয়ে দেবেন। প্রথমে আপনি যে পোশাকই পছন্দ করুন না কেন, মাছুম শুরু করবেন আপনার রুচির প্রশংসা দিয়ে। বলবেন, এই পোশাকটা যেন আপনার কথা ভেবেই তৈরি করা হয়েছে। পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষের মধ্যে আপনার গায়েই পোশাকটা সবচেয়ে ভালো মানাবে। তারপর আপনি দাম জানতে চাইলেই আসবে প্রথম টুইস্ট। তিনি বলবেন, ‘আপনার সাথে কোনো দামাদামি নাই। ড্রেসটা আপনারে মানাইব বইলাই এইটা আপনি একদম কেনা দামে পাইবেন।’
মাছুম দ্বিতীয় টুইস্ট দেবেন যখন আপনি তাঁর চাওয়া দামের অর্ধেক দাম বলবেন। মাছুম কোনো কথা ছাড়াই পোশাকটা প্যাক করতে করতে বলবেন, শুধু আপনি বলেই তিনি অর্ধেক দামে আপনাকে ড্রেসটা দিয়ে দিচ্ছেন। অন্য কেউ হলে এর দ্বিগুণ দামেও দিতেন না। যদিও মাছুম না আপনার আত্মীয়, না বন্ধু, না পরিচিত, এমনকি তাঁর সঙ্গে আপনার এর আগে দেখাই হয়নি কখনো। আপনি শেষ টুইস্টটা পাবেন বাসায় এসে পোশাকটা বন্ধুবান্ধবকে দেখাতেই। বুঝবেন, বিশাল ধরা খেয়েছেন। কিন্তু তখন আর আফসোস করে কিচ্ছু হবে না। কারণ, স্বর্ণালী কাপড় বিতান বিক্রিত মাল ফেরত নেয় না।
ক্রেতাদের দেওয়া রেটিং: ৪.৫/১০
আমাদের রেটিং: ৬.৫/১০

.
.

ফেসবুক সেলিব্রিটি
নাম: রোকনউদ্দিন সুলেমান
ফেসবুক অ্যাকাউন্টের নাম: রকস্ সালমান
ফেসবুক বন্ধুর সংখ্যা: ৫০০০
ফলোয়ার: ১১০০০+
রিভিউ: রকস্ সালমান খেয়ে না-খেয়ে সারা দিন একটাই কাজ করেন। আর সেটা হলো ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া। তিনি এখন বেকার। তাঁর ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসগুলোর অন্যতম বিষয় হলো কীভাবে লেখাপড়া শেষ করে একজন সফল ব্যবসায়ী বা চাকরিজীবী হওয়া যায়। এ ছাড়া তিনি বাসায় শুয়ে-বসে টিভি দেখতে দেখতে ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে মানুষকে টিপস দেন, কীভাবে আরও বেশি পরিশ্রমী ও কর্মঠ হওয়া যায়। সারা দিন ফেসবুক চালানোর কুফল সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার জন্য রকস্ সালমান প্রায় ২৪ ঘণ্টাই ফেসবুকে অবস্থান করেন। তাঁর প্রতিটা স্ট্যাটাসে অনেক লাইক এবং কমেন্ট পড়ে। তবে নিন্দুকদের দাবি, সালমান ছেলেদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করেন না, শুধু সুন্দরী মেয়েদের রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করেন। যদিও তিনি তাঁর অসংখ্য স্ট্যাটাসের মাধ্যমে বলেছেন যে তাঁর কাছে নারী-পুরুষ সমান। পরিশেষে এটুকু বলা যায় যে আপনার যদি কাজকর্ম না থাকে এবং আপনি যদি সারা দিন ফেসবুকে সময় কাটান, তাহলে ফলো করতে পারেন রকস্ সালমানকে।
ফ্যানদের দেওয়া রেটিং: ৮.৫/১০
আমাদের রেটিং: ৫/১০