মালদ্বীপের পর্যটন খাত যে কারণে এগিয়ে

১৩তম সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ উপলক্ষে মালদ্বীপে গিয়েছিলেন প্রথম আলোর ক্রীড়া সাংবাদিক মাসুদ আলম। দ্বীপদেশটির অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাঁকে যেমন মুগ্ধ করেছে, তেমনি উৎসাহ জুগিয়েছে পর্যটন খাতের খোঁজ নিতে

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণেই মালদ্বীপ পর্যটকদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য
ছবি: লেখক

প্রাকৃতিক সম্পদ আর সৌন্দর্যে ভরপুর মালদ্বীপ হলো অসংখ্য দ্বীপের দেশ। ছোট ছোট প্রায় ১ হাজার ২০০ দ্বীপের একটি হলো মালদ্বীপের রাজধানী মালে। ৬ দশমিক ৮ বর্গকিলোমিটারের জনবহুল শহর মালের আশপাশের দ্বীপগুলো পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে।

চারদিকে নারকেল-সুপারিগাছসহ অন্য গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ ছোট্ট দ্বীপ মালে সব সময় লোকারণ্য। এই দ্বীপে পাওয়া যায় সাগরের মধ্যে নগরায়ণের ছোঁয়া। নীলসাগর থেকে আসা মিষ্টি হাওয়া শরীর–মনকে করে তোলে প্রাণবন্ত। এখানে এলে ভ্রমণের সব ক্লান্তি নিমেষেই দূর। এখানকার প্রায় সব কটি পুলে সহজেই নানা ধরনের জল খেলায় মেতে ওঠার সুযোগ আছে।

মালে দ্বীপের পূর্ব দিকে ভারুনুলা রাহুলগান্ধুতে ফেরিতে গেলে অদ্ভুত সুন্দর সূর্যাস্ত দেখা যায়। সার্ফিং ও স্নোর্কেলিং করার উপযুক্ত জায়গা এই মালে দ্বীপ। এখানকার মাস হুনি (টুনা মাছ, নারকেল, পেঁয়াজ, লেবু দিয়ে তৈরি একধরনের খাবার) ও নানা ধরনের ঠান্ডা পানীয় না খেলে চলবেই না। বাঙালি খাবার খেতে চাইলে মালে শহরে অসংখ্য বাঙালি রেস্তোরাঁ আছে।

এখানে পানির নিচে রেস্টুরেন্টে খেতে অন্য রকম এক অভিজ্ঞতা হবে। মালে আইল্যান্ডের পাশাপাশি মালে শহরের মধ্যে আরও কিছু দর্শনীয় স্থানে যেতে পারেন। যেমন কৃত্রিম বিচ, ওল্ড ফ্রাইডে মস্কো, ন্যাশনাল মিউজিয়াম, সুলতানস পার্ক, ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারি, চীনা-মালদ্বীপ ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ, ফিশ মার্কেট ও গ্র্যান্ড ফ্রাইডে মস্কো।

বিভিন্ন মানের রিসোর্ট রয়েছে মালদ্বীপের দ্বীপগুলোতে

মালতে সদ্য সমাপ্ত ১৩তম সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ কাভার করতে গিয়ে পরিচিত হলাম সেখানকার অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে। ছবির চেয়েও বাস্তব, আরও সুন্দর মালদ্বীপের দ্বীপগুলো। মালে থেকে স্পিডবোটে ২৫ মিনিটের দূরত্ব পেরিয়ে ক্রস আইল্যান্ড, মেরিনা দ্বীপে গিয়ে শুধুই মুগ্ধ হওয়ার পালা। প্রকৃতি যেন নিজ হাতে সাজিয়ে রেখেছে দ্বীপটি। আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে মূল আকর্ষণ এর নীল জল; যা দেখতে দেখতে ১৪ থেকে ১৫ বছর ধরে মালেপ্রবাসী ফেনীর খন্দকার ওমর ফারুক বললেন, ‘পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে প্রতিদিন হাজারো মানুষ ছুটে আসেন মালদ্বীপের এই অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে।’

বিমানবন্দর থেকে স্পিডবোট বা ট্রলারে আসা যায় মালে শহরে। তবে পর্যটকেরা মালে শহরে থাকেন না। বিমানবন্দর থেকেই সবাই চলে যান বিভিন্ন দ্বীপে সাজানো–গোছানো রিসোর্টে। মালে থেকে স্পিডবোটে কাছাকাছি বিভিন্ন রিসোর্টে ঘুরে আসার সুবন্দোবস্ত আছে। সেখানে গিয়ে থাকতে চাইলেও থাকতে পারবেন। রিসোর্টে খরচ অনেক বেশি। তবে খরচের তোয়াক্কা না করে পর্যটকেরা আসছেন মালদ্বীপে।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে ৯ লাখ বিদেশি পর্যটক চলে এসেছেন মালদ্বীপে। মালদ্বীপ পর্যটন মন্ত্রণালয়ে লক্ষ্য, প্রতি মাসে গড়ে এক লাখ পর্যটক আনা। স্থানীয় সাংবাদিক হাসান আবদুল্লাহ জানান, বর্তমান সময়ে মালদ্বীপে সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসছেন ভারত থেকে। এর প্রধান কারণ, ভারত থেকে মালদ্বীপ আসার বিমানভাড়া খুবই কম। ভারতের ত্রিবান্ধম, কোচির মতো শহরগুলো থেকে কাছেই মালে। তাই অসংখ্য পর্যটক আসেন। বাংলাদেশিদের বেড়ানোর গন্তব্যে এখন যোগ হয়েছে মালদ্বীপও।

ভ্রমণসঙ্গীদের সঙ্গে লেখক (বাঁয়ে)

কোভিড-১৯-এর কারণে গত বছর সারা বিশ্বেই যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। মালদ্বীপও মুক্ত ছিল না। তারপরও গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন লাখের কিছু বেশি পর্যটক এসেছিলেন দেশটিতে।

এশিয়া থেকে এখন অনেক পর্যটক আসছেন মালদ্বীপে। ভারত, শ্রীলঙ্কার নাগরিকেরা আসেন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মালদ্বীপ তুলনামূলক নিরাপদ। ভারতে গত বছর আইপিএল বন্ধ হয়ে গেলে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের অনেক খেলোয়াড়ই মালদ্বীপ হয়ে দেশে ফেরেন। অস্ট্রেলিয়া সরকার তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তাদের নাগরিকেরা সরাসরি ভারত থেকে অস্ট্রেলিয়ায় যেতে পারবেন না। তাই অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটাররা মালদ্বীপ হয়ে নিজ দেশে যান, যাতে করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা না থাকে।

কিছু ভারতীয়, পাকিস্তানি কাজ করেন সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে। ওই দেশগুলোতে তখন ভারতীয়, পাকিস্তানি বা শ্রীলঙ্কার নাগরিকদের যাওয়া বন্ধ ছিল। এই নাগরিকেরা মালদ্বীপে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিন করে তারপর নিজ নিজ দেশে যান।

গত ইউরোপিয়ান কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট শেষে অনেক খেলোয়াড় মালদ্বীপে বেড়াতে আসেন। ১০-১৫ দিন কাটিয়ে যান এখনকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করে। ইউরোর আগে ১০ দিন মালদ্বীপে ছিলেন আতলেতিকো মাদ্রিদের কোচ ডিয়েগো সিমিওনি। রিয়াল মাদ্রিদ অধিনায়ক মার্সেলো আসেন গত জুলাইয়ে। জেরার্ড পিকে গত বছরের আগস্টে আসেন তাঁর স্ত্রী ও কলম্বিয়ান শিল্পী শাকিরাকে নিয়ে।

মালদ্বীপের বাংলাদেশের হাইকমিশনার মোহাম্মদ নাজমুল হাসান বলছিলেন, ‘গত বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত কোনো পর্যটক আসেননি মালদ্বীপে। কারণ, করোনার হানায় তখন লকডাউন ছিল। এ বছরের জুনে মালদ্বীপের সীমানা খুলে দেওয়া হয়। ডিসেম্বর পর্যন্ত মোটামুটি চললেও এরপর থেকে দিন দিন বাড়ছে পর্যটক।’

করোনার হানায় ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল সব বন্ধ করে দিয়েছিল মালদ্বীপ সরকার, তখনই মালেতে প্রথম করোনা রোগী ধরা পড়ে। ঠিক দুই মাস পর ১৫ জুলাই সব আবার খোলে। প্রথম দিকে অনেক বাধা ছিল। এখানে এলে করোনার নমুনা পরীক্ষা, কোয়ারেন্টিন—সবই বাধ্যতামূলক করা হয়। সরাসরি রিসোর্টে যাওয়া এবং সেখান থেকে কোথাও বেরোতে না পারার বাধ্যবাধকতা জারি করা হয়। এ বছরের এপ্রিলের শেষ দিকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে আবার লকডাউন দেয় মালদ্বীপ সরকার। মে থেকে জুনে বন্ধ ছিল সবকিছু। দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় এখানকার পর্যটনশিল্পটা আরেক দফা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

এই মালদ্বীপই ২০২০ সালে পেয়েছে বিশ্বের সেরা পর্যটক গন্তব্যের স্বীকৃতি। এশিয়ায় এর আগে তারা ২০ বারের মধ্যে ১২ বার সেরা পর্যটন গন্তব্যের স্বীকৃতি পেয়েছিল। গত বছরের স্বীকৃতি এবং পুরস্কার মালদ্বীপের পর্যটনশিল্পের বিকাশে বিশাল এক মাইলফলক বলছেন মালদ্বীপে বাংলাদেশের হাইকমিশনার, ‘ওই স্বীকৃতির পর বিশ্বের বড় বড় সংবাদমাধ্যম মালদ্বীপের ওপর ফিচার করা শুরু করল। যারা মালদ্বীপ সম্পর্কে জানত না, তারাও জানা শুরু করল। এ দেশে পর্যটন বিভাগ অনেক উন্নতি করছে। সরকার পর্যটনশিল্পকে সর্বোচ্চ পৃষ্ঠপোষণা করছে।’

দুই মৌসুম ধরে মালদ্বীপ সরকার স্পেনের ফুটবল ক্লাব সেল্টাভিগোর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। মালদ্বীপ পর্যটন মন্ত্রণালয় দেশটিকে মানুষের আরও কাছে নিতে নানা উদ্যোগের অংশ হিসেবেই এটা করেছে। সেল্টাভিগো তাদের জার্সিতে ব্যবহার করছে ‘ভিজিট মালদ্বীপ’ স্লোগান।

সরকারি হিসাবে, মালদ্বীপের জাতীয় আয়ের সিংহভাগ আসে পর্যটন খাত থেকে; এরপরই মৎস্যশিল্পের অবদান। মালের সাংবাদিক হাবিব ইসমাইলের দেওয়া তথ্য, মালদ্বীপে গত এক বছরে পর্যটন থেকে আয় প্রায় ২ বিলিয়ন রুপিয়া। প্রতিটি রিসোর্ট থেকে সরকারকে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ কর দিতে হয়।

মালেপ্রবাসী বাংলাদেশিরা বলছেন, পর্যটকের সেবার মানে কোনো আপস নেই মালদ্বীপে। হোটেল-রেস্টুরেস্টে খাবার জীবাণুমুক্ত হওয়া বাধ্যতামূলক। সরকারি খাবার পরিদর্শকেরা সবকিছু তদারক করেন। খারাপ কিছু পেলে প্রথমে তাঁরা সতর্ক করেন। কোনো উন্নতি না হলে ব্যবসা বন্ধ করে আদালতে মামলা ঠুকে দেয় সরকারি ওই সংস্থা।

মালদ্বীপে এক দিনে একটি রিসোর্টে থাকতে ১০০ থেকে ১৫০ ডলার খরচ। ভালো রিসোর্টে থাকতে প্রতিদিন খরচ ২০০ থেকে ৩০০ ডলার। পাঁচতারকা রিসোর্টে ৭০০ থেকে ৮০০ ডলারও লাগে। বিলাসবহুল রিসোর্টে খরচ আরও বেশি। তারপরও অনেক পর্যটক আসছেন দ্বীপদেশটিতে। কোভিডের হানায় মালদ্বীপের পর্যটনে খরা কাটিয়ে এখন ভরা জোয়ার বইছে।