মায়ের ওপর বিরক্ত?

মায়ের সঙ্গে দ্বন্দ্ব কেন বোঝার চেষ্টা করুন। মডেল: লোপা ও রৌদুস, ছবি: সুমন ইউসুফ
মায়ের সঙ্গে দ্বন্দ্ব কেন বোঝার চেষ্টা করুন। মডেল: লোপা ও রৌদুস, ছবি: সুমন ইউসুফ

জেন অস্টিনের প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস উপন্যাস। মা মিসেস বেনেট চান মি. কলিন্সকে তাঁর মেয়ে এলিজাবেথ বিয়ে করুক, কিন্তু এলিজাবেথ কলিন্সকে প্রত্যাখ্যান করে। সেখান থেকে মা-মায়ের দ্বন্দ্ব, দুজনের কথা-কাটাকাটি আর সম্পর্কের টানাপোড়েন। কেবল উপন্যাসেই নয়, চারপাশে মায়ের প্রতি মেয়ের রাগ আর বিরক্তির দৃশ্য প্রায়ই দেখা যায়।
বেশির ভাগ মেয়েরই সবচেয়ে কাছের বন্ধু হচ্ছেন তাঁর মা। মায়ের সঙ্গেই তাদের সখ্য সবচেয়ে বেশি। মেয়ে তার আবদার, চাওয়া-পাওয়া, ভালো লাগা, মন্দ লাগা ভাগাভাগি করে নেয় মায়ের সঙ্গে। এর ব্যতিক্রমও দেখা যায়। সেসব ক্ষেত্রে মায়ের সঙ্গে মেয়ের দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে। যেমন, ‘মা, তুমি কিচ্ছু বোঝো না’—বলে কথায় কথায় রেগে ওঠে তমা (ছদ্মনাম)। বয়স তার সতেরো। পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে তার সম্পর্ক স্বাভাবিক, কিন্তু মাকে সে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। মায়ের প্রতি তার বিরক্তি আর রাগ। মা কিছু বললেই সে ঝাঁজিয়ে ওঠে। কথায় কথায় তর্ক করে, সব ব্যর্থতার জন্য মাকে দায়ী করে এবং মায়ের কোনো নির্দেশ সে পালন করতে চায় না। মায়ের বিরোধিতা করাই যেন তার প্রধান কাজ। বাবা অনেক চেষ্টা করেন তমাকে তার মায়ের প্রতি অনুগত করার; কিন্তু যেই কে সেই...তার সমস্যা যেন দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। আজকাল সে মায়ের সঙ্গে কথাই বলে না।
ড. দেবোরাহ তানিন, জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভাষা গবেষক; মা-মেয়ের কথোপকথন বিশ্লেষণ করে একটি গবেষণা গ্রন্থে লিখেছেন, ‘মা-মেয়ের সম্পর্কের মধ্যে একটা টেনশন কাজ করে—মা সব সময় চান মেয়েকে কিছু উপদেশ দিতে, যা তার জীবনকে সহজ আর নিরাপদ করে, আর মেয়ে ভাবে মা তার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন, তাই মায়ের উপদেশগুলোকে সে দেখে সমালোচনা হিসেবে।’ এমনকি মা যখন মেয়ের কোনো প্রশংসাও করেন, তখনো মেয়ের মনে হতে পারে যে মা তার সমালোচনা করছেন। যেমন দেবোরাহ তাঁর বইতে দেখিয়েছেন, মা যদি বলেন, ‘তোমার চুলগুলো কত্ত সুন্দর, একটু যত্ন নিলে আরও ভালো লাগবে’—মেয়ে কিন্তু এটার অন্তর্নিহিত মানে করে নেয়, মা বলছেন, ‘তোমার চুলগুলো দেখতে মোটেই ভালো লাগছে না।’ দেবোরাহ এসব ক্ষেত্রে মেয়েদের উপদেশ দিয়েছেন, মায়ের কথাকে সমালোচনা মনে করলেও এর মাঝে যে ‘কেয়ারিং’ লুকিয়ে আছে, তা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। মায়েদের জন্য তিনি বলেছেন, মেয়েকে দেওয়া নির্দেশগুলো বলার ক্ষেত্রে শব্দচয়ন, দেহভঙ্গি, স্বরের ওঠানামা এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে, যাতে সেখানে কর্তৃত্ব আর সমালোচনা প্রকাশ না পায়।
নানান কারণে মায়ের ওপর মেয়ের রাগ আর বিরক্তি হতে পারে। মায়ের কোনো আচরণে যদি সে তীব্র মনঃকষ্টে ভোগে বা প্রতিনিয়ত হতাশ হয়, যেমন মা যদি সার্বক্ষণিকভাবে তাকে উপদেশ-নির্দেশ দিতে থাকেন বা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে বারবার তাকে বকাবকি করতে থাকেন, মা–বাবার মধ্যে যদি তুমুল দাম্পত্য কলহ চলতে থাকে, আশপাশের মানুষজন, বিশেষত পরিবারের অন্যান্য সদস্য যদি প্রতিনিয়ত তার মাকে কটুবাক্য শোনাতে থাকে, মেয়ের মনে যদি কোনো অমীমাংসিত দ্বন্দ্ব বা তীব্র মানসিক চাপ তৈরি হয় এবং নাটক-সিনেমার রোলমডেলরা যদি নাটকে বা সিনেমায় এ ধরনের চরিত্রে অভিনয় করে থাকেন, তখন মেয়ের মনে মায়ের প্রতি বিরাগ জন্ম নিতে পারে। এ ছাড়া পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার, কনডাক্ট ডিসঅর্ডার বা মাদকাসক্তি–জাতীয় মানসিক সমস্যা যদি মেয়ের থাকে, তখন মায়ের প্রতি বা মা-বাবা দুজনের প্রতি তার প্রচণ্ড রাগ ও অবাধ্যতা তৈরি হতে পারে।

করণীয় কী
 মেয়েকে বুঝতে শিখুন, বিশেষ করে মেয়েটি সদ্য বয়ঃসন্ধিকালে পা দিয়ে থাকলে তার পছন্দ–অপছন্দের মূল্য দিন।
 মেয়েকে সব সময় দোষারোপ করবেন না। তার সব কর্মকাণ্ড নিয়ে কটূক্তি, সমালোচনা বন্ধ করুন।
 নিরাপত্তার অজুহাতে তার ওপর অতিরিক্ত নজরদারি করবেন না, যাতে সে নিজেকে আবদ্ধ মনে করে।
 দাম্পত্য কলহ এড়িয়ে চলুন। মতের অমিল হলেই শিশুকে সাক্ষী মেনে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের বিরুদ্ধে বলবেন না।
 মেয়ের মধ্যে কোনো মানসিক চাপ বা দ্বন্দ্ব রয়েছে কি না, জানার চেষ্টা করুন। বাড়িতে, স্কুলে বা অন্যত্র সে কোনো ধরনের নিপীড়নের শিকার হয়েছে কি না, জানার চেষ্টা করুন।
 মেয়ে যদি কারও সঙ্গে আবেগীয় সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, তখন উত্তেজিত না হয়ে তার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা কথা বলুন।
 মেয়ের মধ্যে বিষণ্নতা, উৎকণ্ঠা, পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার, কনডাক্ট ডিসঅর্ডার, মাদকাসক্তি বা অন্য কোনো মানসিক সমস্যার লক্ষণ থাকলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করুন।
মা নিজে কোনো মানসিক চাপে আছেন কি না, সেটাও দেখতে হবে। প্রয়োজনে মায়ের মানসিক চাপ নিরসনের জন্য পরিবারের অন্য সদস্যদের উদ্যোগ নিতে হবে।