
সিউল থেকে ফিরছিলাম সেবার অফিসের কাজ শেষ করে। ছয় ঘণ্টার যাত্রাবিরতি, বসে আছি সিঙ্গাপুরের চ্যাংগি বিমানবন্দরে। আমাকে ঢাকায় উড়িয়ে নেওয়ার বিমান পাখা মেলবে সন্ধ্যার পরে, আর তা ঢাকার মাটি ছোঁবে মাঝরাত্তিরে। রাতদুপুরে বিমানবন্দর থেকে বাসায় ফেরার কী গতি করব, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম। এমন সময় ২০ থেকে ২২ বছরের এক যুবক আমার পাশে এসে বসল। খানিকটা ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাই, আপনি কি বাংলাদেশি?’
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। যুবক আমার দিকে একটু সরে এসে বসল। আমিও একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। যাক, অন্তত একজন দেশি মানুষের সন্ধান মিলল। এই পরদেশে, কিছুটা সময় কাটানো যাবে তার সঙ্গে কথা-টথা বলে!
কথা বলে জানা গেল, তার নাম রাশেদ। বাড়ি দেশের উত্তরাঞ্চলে। সে তার বাবাকে হারিয়েছে খুব ছোটবেলায়। একটা ছোট বোন আছে তার। মা সেলাইমেশিন চালিয়ে তাদের দুই ভাইবোনকে বড় করেছেন। রাশেদকে পড়িয়েছেন উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত, মাস দুয়েক আগে ছোট বোনটাকে বিয়ে দিয়েছেন। দেশে সে রকম কর্মসংস্থানের আশা না পেয়ে সহায় সম্বল বেচে রাশেদ ধরেছে মালয়েশিয়ার পথ। কথা বলে জানলাম, তিন দিন আগের একটা ফ্লাইটে সে ঢাকা থেকে এসেছে সিঙ্গাপুরের এই বিমানবন্দরে। দালালের কাছ থেকে সবুজসংকেত পেলে সে এখান থেকে মালয়েশিয়ার বিমান ধরবে। ব্যাপারটা আমার মাথায় ঠিক ঢুকছিল না। আমার জানামতে কানেক্টিং বিমানের টিকিট কাটতে হয় আগেই, বিমান ও ফ্লাইটও নির্দিষ্ট করা থাকে আগে থেকে। সে কথা তাকে বলতেই সে বলল, দালালের লোক এসে তাকে খুঁজে নেবে। তার কাছে রয়েছে আরেকটা পাসপোর্ট, তাতে ভিসা লাগানো আছে, তার কাছ থেকে সেটা নিয়েই উড়বে সে মালয়েশিয়ার আকাশে। এ কথা বলার সময় তার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
জিজ্ঞেস করলাম এ তিন দিন সে কীভাবে কাটিয়েছে, কী খেয়েছে।
বলল, ‘কী আবার খাব? সস্তা রুটি আর বিমানবন্দরের ফ্রি পানি।’
ভেবেছিলাম রাশেদের সঙ্গে কথা বলে মনটা হালকা হবে। হলো তার উল্টোটা। বাকি সময়টা মুখ গোমড়া করে বসে থাকলাম। সে-ও বসে থাকল চুপ করে। যখন আমি আমার বিমান ধরার জন্য উঠছি, তখন সে এক টুকরো কাগজ এগিয়ে দিল আমার দিকে। একটা মোবাইল নম্বর লেখা তাতে। ভাঙা গলায় বলল, ‘ভাই, এটা আমার মায়ের নম্বর। আমার একটা উপকার করবেন। ঢাকায় নেমে যত রাতই হোক, আমার মাকে একটা ফোন দেবেন। বলবেন, আমি ভালো আছি।’ কথা কটা বলেই রাশেদ আর দাঁড়াল না। হাতের তালুতে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল দূরে, মিশে গেল মানুষের স্রোতে।
আমি ঢাকায় নেমে প্রথমেই রাশেদের মাকে ফোন দিলাম। তখন অনেক রাত, তারপরও ফোন ধরলেন তিনি দুবার রিং বাজার পরেই। রাশেদের সংবাদ বলতেই শব্দ করে তিনি কাঁদলেন ওপাশে কিছুক্ষণ। তারপর একটু সময় নিয়ে ধাতস্থ হলেন, আমার জন্য অনেক দোয়া করে কথা শেষ করলেন।
আখতারুজ্জামান
উত্তর বাড্ডা, ঢাকা।