১৯৮৫ সাল। সবে চিকিৎসক হিসেবে পেশাজীবনে যোগ দিয়েছেন জাকির হোসেন। চিকিৎসক বাবা ওয়াছিম উদ্দিন আহমেদকে দেখে মানুষের সেবা করার মানসিকতা গড়ে উঠেছিল ছোটবেলায়। পেশাগতভাবে সেটির শুরু তখন। চেয়েছিলেন প্রথম মাসের বেতন মায়ের হাতে তুলে দেবেন। কিন্তু পারেননি! উচ্চ রক্তচাপজনিত রোগে তাঁর মা মোছা. ওয়ালেদা খাতুনের আকস্মিক মৃত্যু হয়। মাকে হারানোর শোক দাগ কাটে তরুণ জাকির হোসেনের মনে।
যে উচ্চ রক্তচাপজনিত রোগে মাকে হারিয়েছেন, একসময় সে বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে শুরু করেন। মনের ভেতর লালন করেন বড় কিছু করার। সেই স্বপ্ন জাকির হোসেন পূরণ করেন ২০০৮ সালে রংপুরে ‘হাইপারটেনশন অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করে। নামমাত্র নিবন্ধন ফি দিয়ে এখানে রোগীরা পান চিকিৎসাসেবা।
অধ্যাপক জাকির হোসেন গত বছরের ডিসেম্বরে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। এখন বগুড়ায় একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন। সেখান থেকেই নিয়ম করে অনলাইনে হাইপারটেনশন অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের খোঁজ নেন, পরামর্শ দেন রোগীদের।
জাকির হোসেন কথায় কথায় জানালেন, সরকারি চাকরির সুবাদে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। ছিলেন বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের প্রধান। তারও আগে এক দশক যুক্ত ছিলেন ঢাকার এস জি এম চৌধুরী মেমোরিয়াল হাইপারটেনশন সেন্টারে। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত মানুষকে স্বল্প মূল্যে সেবা দেওয়া এবং এ বিষয়ে গবেষণা করতে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার পরিকল্পনা করছিলেন তখন। সেই পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ দিতে পারেন রংপুরে এসে। অধ্যাপক জাকির হোসেন তখন রংপুর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল। তাঁর কথা শুনে সহযোগিতার মনোভাব দেখান অনেকে। ডা. জাকির ভাবলেন, আর দেরি নয়। নিজের বাড়ি বগুড়ায় হলেও রংপুরেই এই কার্যক্রম চালু করার সিদ্ধান্ত নিলেন। ২০০৮ সালের ১৪ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে রংপুর শহরে চালু হলো ‘হাইপারটেনশন অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার’। প্রতিষ্ঠানটি এখন পরিচালিত হয় তাঁর প্রয়াত মা-বাবার স্মরণে চালু করা ওয়াছিম-ওয়ালেদা বহুমুখী কল্যাণ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে।
একবার নিবন্ধন, তিন মাস সেবা
রংপুর শহরের হাইপারটেনশন সেন্টারে গিয়েছিলাম ২৬ মে। করোনাকাল বলে রোগীর সংখ্যা কম। তবু নতুন ও পুরোনো রোগী মিলে সেই সংখ্যাও কম নয়। কোথাও একজনকে, আবার কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মেনে দলবদ্ধভাবে উচ্চ রক্তচাপের বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
হাইপারটেনশন অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারে আসা এই রোগীদের চিকিৎসাসেবায় কোনো অর্থ নেওয়া হয় না। তবে নিবন্ধন ফি নেওয়া হয়। নিবন্ধিত রোগীরা এ গবেষণা কেন্দ্রের সদস্য হয়ে যান। এক নিবন্ধনেই তিন মাস চিকিৎসা পরামর্শ পান রোগীরা। আগে ৪০ টাকায় নিবন্ধন করা যেত। এখন তা ৫০ টাকা। তবে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অসহায়-দুস্থ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে কোনো নিবন্ধন ফি নেওয়া হয় না। নিবন্ধিত রোগীরা তিন মাস বিনা মূল্যে চিকিৎসা পরামর্শ ও সেবা পান।
নিবন্ধিত রোগীরা শুধু যে চিকিৎসাসেবা পান, তা নয়। তাঁদের করণীয় বিষয়ে একটি পুস্তিকাও দেওয়া হয়। রোগীর জীবনযাপনসহ প্রতিদিন নিয়মকানুন কীভাবে মেনে চলতে হবে, এসব লেখা আছে ওই পুস্তিকায়। সেই সঙ্গে রোগীকে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবাও প্রদান করেন চিকিৎসক নিজে। এ ছাড়া অন্য কোনো রোগ থাকলে তারও চিকিৎসাসেবার পরামর্শ বিনা মূল্যে প্রদান করা হয়।
করোনাকালে রোগীরা মুঠোফোনের মাধ্যমেও সেবা পেয়ে আসছেন। জাকির হোসেন জানালেন, প্রতিষ্ঠার প্রথম দিন মাত্র ৯ জন রোগী সেবা নিতে এসেছিলেন। এক যুগে সেন্টারে নিবন্ধিত রোগীর সংখ্যা (২৫ মে পর্যন্ত) ২৬ হাজার ৪৯৩। সেবা দেন ১৯ জন চিকিৎসক। আছেন ৬০ জন কর্মী। সেন্টারে রংপুর ছাড়াও কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা, বগুড়া, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নওগাঁ জেলাসহ আরও কিছু এলাকা থেকে সেবা নিতে আসেন রোগীরা।
কেউ নতুন, কেউ পুরোনো
রংপুরের কামালকাছনা এলাকার বাসিন্দা আয়েশা খাতুনের বয়স এখন ৫৯। উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। হাইপারটেনশন অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের পুরোনো রোগী তিনি। চার বছর ধরে চিকিৎসাসেবা পেয়ে আসছেন। তিনি বললেন, ‘যখনই সমস্যা হয় তখনই এখানে ছুটে আসি। ঘন ঘন আসতে হয়। চিকিৎসাসেবা পাই। তা ছাড়া টাকাপয়সা লাগে না।’
লালমনিরহাট থেকে আসা রাবেয়া আক্তার (৪৮) এখানকার নতুন রোগী। তিনি জানালেন, তাঁর বুক ধড়ফড় করে, অস্থিরভাবও আছে, প্রায়ই মাথার পেছনের অংশের ব্যথায় ভোগেন। এমন উপসর্গ নিয়ে রংপুরে চিকিৎসকের কাছে এসেছিলেন। তারপরই খোঁজ পান এই সেন্টারের। অল্প টাকায় সেবা পাওয়ার আশায় সেদিন এসেছেন। তিনি বলেন, ‘৫০ টাকা নিবন্ধন করে এখানকার সদস্য হয়েছি। এখানে রোগীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হয়। যা জানতে চাই সবকিছুই বুঝিয়ে দেয়।’
কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলা থেকে এসেছিলেন কলেজশিক্ষক জামাল উদ্দিন সরকার। তিনি বলেন, ‘মনোযোগ দিয়ে ডাক্তার রোগীর কথা শোনেন। এরপর ওষুধ দেন। নিয়মকানুন বলে দেন।’
শুধু চিকিৎসাসেবা নয়
বিশ্বে ১৫০ কোটির বেশি মানুষ হাইপারটেনশনে আক্রান্ত। বাংলাদেশেও প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ২১ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। নানা কারণে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। সে সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে বিভিন্ন এলাকায় হাজির হন হাইপারটেনশন অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের চিকিৎসকেরা। রক্তচাপ পরীক্ষাসহ নিয়মিত জনসচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। এ ছাড়া রংপুরের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চ রক্তচাপ বিষয়ে সেমিনারের আয়োজন করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। জানা গেল, এ পর্যন্ত ২৬৭টি সেমিনার, ২৭টি বৈজ্ঞানিক সেমিনার, ৩৮টি মেডিকেল ক্যাম্প করা হয়েছে।
জাকির হোসেন বলেন, ‘নীরব ঘাতক ব্যাধি হলো উচ্চ রক্তচাপ। এ রোগে আক্রান্তদের মাঝেমধ্যে চিকিৎসকের কাছে ছুটে যেতে হয়। সাধারণ মানুষ খরচের কথা ভেবে যান না। তাঁদের জন্যই এই প্রতিষ্ঠান।’ জানালেন, ভবিষ্যতে রোগীদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা দিতে আরও বড় কিছু করার চিন্তা রয়েছে তাঁদের।