
আমার বড় ভাইয়ের নাম আতিকুল ইসলাম শাকিল। ২০১৪ সালের ৯ আগস্ট শাকিল মারা যায়। সে আমার মায়ের সবচেয়ে আদরের ছেলে ছিল। শান্ত স্বভাবের আমার ভাই মা-বাবা ও ফুফুকে সর্বদা নানা রকম কাজে সাহায্য করত। সঙ্গদোষের কারণে সে আস্তে আস্তে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। যে কারণে ঘরে ভাইবোন ও স্বজনের অনেক ঘৃণা, অপমান আর লাঞ্ছনা সইতে হয়েছে শাকিলকে। মাও তাকে বকাঝকা করতেন। মাঝেমধ্যে তাকে খাবার খেতে দিতেন না। যখন সে ঘর থেকে চলে যেত তখন মা বসে বসে ছেলের জন্য কাঁদতেন। বড় ভাই হয়েও ঠিক ছোট ভাইয়ের মতো আমার সঙ্গে খুব বিনয়ী হয়ে কথা বলত। আমার ভাই মাদকাসক্ত হওয়ায় আমি ওর সঙ্গে অনেক খারাপ আচরণ করেছি।
মা তাকে নেশার ওই জগৎ থেকে ফিরিয়ে আনতে অনেক চেষ্টা করেছিলেন। একটা সময় সে নিজেও অনেক চেষ্টা করেছে। পারিপার্শ্বিকতা ও খারাপ সঙ্গীদের কারণে পারেনি। ২০১৪ সালের রোজার ঈদের পরের দিন রাতে আমার বড় বোন রুনা, মা ও ফুফু তাকে সুস্থ করে তোলার জন্য একটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে দিয়ে আসেন। মা তো আর তখন জানতেন না ওই যাওয়াই ছিল তাঁর ছেলের শেষ যাওয়া। ছেলে সুস্থ হওয়ার পরিবর্তে ফিরল লাশ হয়ে।
সেদিন আমার মা, আমার অসুস্থ বাবা, ভাইবোন, ফুফুসহ স্বজনেরা অনেক কেঁদেছিলেন। আমি কাঁদতে পারিনি। সেদিন ভাইয়ের লাশ কাঁধে নেওয়ার আগে দুর্ব্যবহারের জন্য ওর পা স্পর্শ করে বলেছিলাম, ভাই রে, ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটা এই হতভাগাকে দিলি না।
নেশায় আক্রান্ত হওয়ায় মা-বাবা ও পরিবারের আদর, স্নেহ, ভালোবাসা কোনোটাই পায়নি সে। পেয়েছে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, ঘৃণা, অবহেলা ও বকাঝকা। আমার ভাইয়ের মৃত্যু আমার পরিবারকে পুরোপুরি ভেঙে দিয়েছে। ঘৃণা, অবহেলা আর তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের পরিবর্তে পরিবারের সবাই যদি আদর-যত্ন, স্নেহ-ভালোবাসা আর তার যে মর্যাদা ছিল সেটি দিতে পারতাম, হয়তো সে আজ আমাদের সঙ্গে থাকত। তাকে হারানোর পরিবর্তে নেশার জগৎ থেকে দূরে রাখতে পারতাম। খুবই সাধারণ এই বিষয়টি ভাই মারা যাওয়ার পরই বুঝতে পেরেছি। যদি তাকে ভালোবাসা দিয়ে বোঝাতে পারতাম, পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে চেষ্টা করতাম—তাকে সুস্থ করতে পারতাম!
আমার মা মাঝেমধ্যে পাগলের মতো আচরণ করেন। মধ্যরাতে দরজা খুলে বসে থাকেন। রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকেন। হয়তো তাঁর ছেলে ফিরে আসবে।