মা-ছেলের 'যুদ্ধজয়'

জন্মের প্রথম বছর ঘটা করেই হলো রাফসানের জন্মদিন। হই–হুল্লোড় করে বাচ্চারা বেশ মজা করেছে। কিন্তু এত সব হুল্লোড়ের মধ্যে মায়ের মনে খটকা। ডাকলে শোনে না ছেলে। খচখচ করে মন। বছর বাড়তে শঙ্কা চেপে বসল মনে, ‘তবে িক ছেলে শুনতে পায় না।’ শেষ পর্যন্ত শঙ্কাই সত্য হলো। চিকিৎসক জানালেন, রাফসান কানে শোনে না, গলার স্বর ঠিক থাকলেও কথা বলতে পারছে না কানের সমস্যার কারণে।
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে মায়ের। ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়ানোর সংকল্প করেন। ছেলে শ্রবণ ও বাক্প্রতিবন্ধী হয়েছে তাতে কী! অনেক কিছুই করার আছে তার—এভাবে শুরু মায়ের যুদ্ধ, যার প্রমাণ হাতে হাতে দিয়েছে রাফসান। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় সে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে জিপিএ-৪ পেয়েছে। গত সোমবার রাফসানুল হককে নিয়ে প্রথম আলোর চট্টগ্রাম কার্যালয়ে আসেন মা রুবিনা পারভীন হক। শোনান তাঁর যুদ্ধজয়ের গল্প।
শুরুতেই ফিরে যান সেই দিনগুলোতে। বললেন, ‘রাফসান আমার একমাত্র সন্তান। জন্মের পর সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল। সব উলটপালট করে দেয় চার মাস বয়সে হওয়া টাইফয়েড। প্রচণ্ড জ্বর হয় রাফসানের। এরপর ভালোও হয়েছে। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। এক বছর বয়স থেকে বিষয়টা আমার চোখে ধরা পড়ে। তারপরও মনে হয়েছে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আর ঠিক হয়নি।’ এইটুকু বলে থামেন পারভীন। চোখে পানি তখন টলমল। মায়ের চোখের পানি দেখে পাশে বসা রাফসান হাসিমুখে মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আশ্বস্ত করে ইশারায়। পারভীন চোখের পানি মুছে স্বাভাবিক হন।
আবার শুরু করেন। বললেন, যখন জানলাম ছেলে শ্রবণ ও বাক্প্রতিবন্ধী, তখন থেকেই জীবনধারা পাল্টে ফেললাম। স্বল্প আয়ের সংসারেও ছেলের জন্য আলাদা সবকিছু করতে লাগলাম। ঘরেই শুরু করলাম তার পড়াশোনা। পাঁচ বছর বয়সে ভর্তি করালাম মুরাদপুর মূক ও বধির স্কুলে। সেখান থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় পাস করলে ভর্তি করাই মুরাদপুরের রহমানিয়া উচ্চবিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই জেএসসি ও এসএসসি পাস করেছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সর্বাত্মক সাহায্য করেছেন।’
রহমানিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকএ কে এম আলমগীর কবির বলেন, ‘রাফসান ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই আমার কাছে পড়েছে। ইশারায় তাকে বুঝিয়ে দিতাম। সে দ্রুত সবকিছু আয়ত্ত করতে পারত। পড়ার প্রতি ভীষণ আগ্রহ তার। অবশ্য রাফসানের এই সাফল্যের পুরোটাই মায়ের কৃতিত্ব। ঘরে তার মা পড়াগুলো তাকে ইশারায় আরও ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতেন। আমি অন্য মায়েদের বলব, সন্তান প্রতিবন্ধী হলেই বোঝা নয়। রাফসান তার প্রমাণ।’
রাফসানদের সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম বাবা মোজাম্মেল হক। তিনি নগরের একটি বিপণিকেন্দ্রের দোকানের বিক্রয়কর্মী। মুরাদপুরের একটি পাঁচতলা ভবনের চিলেকোঠায় দুই কামরার ঘরে তঁাদের বসবাস। আয়ের অর্ধেকই ব্যয় হয়ে যায় রাফসানের পেছনে। বাকিটা দিয়ে টেনেটুনে চলে সংসার। অবশ্য রাফসান পড়ার জন্য পেয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট বৃত্তি। এ ছাড়া এ কে খান ফাউন্ডেশনও সব সময় বৃত্তি দিয়ে যাচ্ছে তাকে।
এ কে খান ফাউন্ডেশনের বিভাগীয় সমন্বয়কারী আবুল বাসার বলেন, ‘রাফসান যত দিন পড়বে আমরা তাকে বৃত্তি দিয়ে যাব। তার মতো প্রতিভাবানদের খুঁজে বের করা আমাদের দায়িত্ব।’
শুধুই যে পড়ায় থাকে রাফসান তা নয়, ভালো ছবিও আঁকে সে। তার আগ্রহের বিষয় প্রকৃতি আর মানুষের মুখ। ইতিমধ্যে শিল্পকলা একাডেমিতে তার একটি প্রদর্শনীও হয়েছে। এ ছাড়া কম্পিউটার গ্রাফিকসের কাজও শিখছে এখন। পারভীন বলেন, ‘ঘর ভর্তি তার ছবিতে। পড়ার বাইরে যা সময় থাকে তাতে শুধু ছবিই আঁকে।’
মায়ের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে এক টুকরো কাগজে লিখে রাফসানের কাছে জানতে চাই, বড় হয়ে কী হবে? উত্তরে রাফসান লেখে, ‘গ্রাফিকস ডিজাইনার হব। আর বিবিএ পড়ব।’
রাফসানকে নিয়ে মায়েরও অনেক স্বপ্ন। তিনি বলেন, ‘আমি হারার পাত্র নই। ছেলেকে পড়াশোনা করে অনেক বড় করব। এই আশা নিয়ে বেঁচে আছি।’