মিশন মানব পাচারের আস্তানা

থাইল্যান্ডের গহিন জঙ্গলে আবিষ্কৃত হলো গণকবর। গভীর সমুদ্রে নৌকায় ভাসছে অসহায় ক্ষুধার্ত হাজারো মানুষ। সেখানে আছেন বাংলাদেশিরাও। ঘটনা অনুসন্ধানে প্রথম আলোর প্রতিবেদক ছুটলেন সেখানে।
১৪ মে, ২০১৫: আন্দামান সাগরে ভাসমান হতভাগ্য মানুষ। ছবি: এএফপি
১৪ মে, ২০১৫: আন্দামান সাগরে ভাসমান হতভাগ্য মানুষ। ছবি: এএফপি

৭ মে প্রধান বার্তা সম্পাদক লাজ্জাত এনাব মহছির ফোন, ‘টিপু, থাইল্যান্ড যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হও।’

পত্রপত্রিকায় থাইল্যান্ডের গণকবরের খবর তখন বেরোচ্ছে। পাচার হয়ে যাওয়া মানুষ ভিনদেশে গিয়ে লাশ হচ্ছে, সে খবরে পুরো দেশ স্তম্ভিত। আমিও আমার মতো করে বিষয়টি নিয়ে পড়াশোনা করছি। বিশেষ করে থাইল্যান্ডের পত্রপত্রিকাগুলোর দিকে রাখছি তীক্ষ্ণ নজর। ওয়েবসাইট ঘাটতে ঘাটতে দেখি, থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়ায় মানব পাচারের ব্যাপারে বহু আগে থেকেই খবর বের হচ্ছে সে দেশের পত্রিকায়। আমি মূলত ব্যাংকক পোস্ট, দ্য নেশন পত্রিকার দিকে চোখ রাখছিলাম। ওয়েবসাইট ঘাটতে ঘাটতেই নজর পড়ল ফুকেত ওয়ান ওয়েব পোর্টালের দিকে। নৌকায় মানব পাচারের বিষয়টি সাম্প্রতিক সময়ের নয়, ২০০৮ সাল থেকেই যে এ ব্যাপারটি নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে, জানতে পারলাম এই পোর্টালটি থেকে। অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক অ্যালান মরিসন এই পত্রিকার কর্ণধার। মূলত পর্যটনকে উৎসাহিত করার জন্য এই ওয়েবসাইট, কিন্তু বিভিন্ন বিষয়েও লেখালেখি থাকে এখানে। ঢাকায় থাকতেই যোগাযোগ করলাম অ্যালানের সঙ্গে। থাইল্যান্ডে যাওয়ার পর তাঁর সহযোগিতা পাওয়া যাবে।
সম্পাদক মতিউর রহমান ঠিক করেছিলেন, এত বড় একটা ব্যাপার ঘটছে থাইল্যান্ডে সেখানে আমাদের পত্রিকার কারও যাওয়া উচিত। সম্পাদকের আগ্রহেই দায়িত্বটা আমাকে দিলেন লাজ্জাত এনাব মহছি।
সামনে শুক্রবার। ফলে ভিসা আবেদন, ভিসা পাওয়া ইত্যাদির জন্য আরও কয়েক দিন লাগবে। এই সময়টি কাটালাম পড়াশোনা করে। ভিসা পেলাম ১৩ মে বিকেলে, সে রাতেই পাড়ি জমালাম ব্যাংককে। পৌঁছালাম পরদিন সকালে।

ভয়ংকর যাত্রা: সমুদ্রে ভাসমান মানুষের করুণ আর্তি। ছবি: এএফপি
ভয়ংকর যাত্রা: সমুদ্রে ভাসমান মানুষের করুণ আর্তি। ছবি: এএফপি

যাত্রা ভয়ংকর
থাইল্যান্ডে পা রেখেই আমার যে পরিচিতজনেরা ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করলাম। যাঁরা থাইল্যান্ডের গণকবরের খবরগুলো পড়েছেন বা টেলিভিশনে দেখেছেন, তাঁরা ইতিমধ্যেই জেনে গেছেন, থাইল্যান্ডের দক্ষিণের দুর্গম এলাকায় মানব পাচারকারীরা হতভাগ্য মানবসন্তানদের নিয়ে আসে। এখানেই তাদের জিম্মি করে রাখে। মুক্তিপণ চায়। মুক্তিপণ না পেলে চলে ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতন।
ব্যাংককে বাংলাদেশের দূতাবাসে গিয়ে ভালো সহযোগিতা পেলাম। গত এক বছরেই অন্তত ১ হাজার ২০০ হতভাগ্য মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন দূতাবাসের কর্মকর্তারা। গত ৬ মাসে তাঁরা ৮০০ মানুষকে ফেরত পাঠিয়েছেন দেশে। পর্যটন ভিসা নিয়ে আমি সাংবাদিকতা করলে বিপদে পড়তে পারি, এ কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন কয়েকজন।

মালয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী থাইল্যান্ডের সংখলা প্রদেশের এই জায়গায় এসে শুরু হয় জঙ্গলের পথে যাত্রা। ছবি: থাইল্যান্ডের স্থানীয় পত্রিকা থেকে সংগৃহীত
মালয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী থাইল্যান্ডের সংখলা প্রদেশের এই জায়গায় এসে শুরু হয় জঙ্গলের পথে যাত্রা। ছবি: থাইল্যান্ডের স্থানীয় পত্রিকা থেকে সংগৃহীত

আমি চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে অনেকবার গেছি। কিন্তু দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে যাওয়া হয়নি কখনো। পেদাং বেসার, সংখলা প্রদেশের সাদাও—এসব এলাকা আমার একেবারেই অপরিচিত। তা ছাড়া এসব জায়গায় যাওয়াও নিরাপদ নয়। ১৫ মে আমি বিমানে করে চলে গেলাম হাজ্জাই শহরে। এটি দক্ষিণের একটি শহর। তবে নিরাপত্তা আছে। এর আগে ফুকেত ওয়ানের অ্যালান ও তার রিপোর্টার চুতিমার সঙ্গে কথা বলে নিয়েছি। তাঁরা দক্ষিণে যাওয়ার পর ফিক্সার বা গাইড ও দোভাষী জোগাড়ে সহায়তা করলেন। দিনে ২০০০ বাথে (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫০০০ টাকা) রফা হলো। কিন্তু এই ফিক্সারটি আমার সঙ্গে সহযোগিতা করলেন না। ফোন করে বললেন, ‘আমি এক দিনে ২০০ মার্কিন ডলার নিই।’ তার মানে দিনে ৬০০০ বাথ। শুনে আমার মাথা ঘুরে গেল। তাঁকে মনে করিয়ে দিলাম, অ্যালান বলেছেন ২০০০ বাথের কথা। কিন্তু মেয়েটা নানা বাহানা করতেই লাগলেন। বললেন, কাল তাঁর বাচ্চার সঙ্গে থাকতে হবে, তাই আমার সঙ্গে বের হতে পারবেন না। কী মুশকিল!
শুনলাম, চুতিমা তখন হাজ্জাইতে আছেন ইংল্যান্ডের চ্যানেল ফোরের একটি দলের সঙ্গে। উঠেছেন চায়না গোল্ড হোটেলে। সেখানেই চুতিমার সঙ্গে কথা হলো। বললাম, আমাকেও তাঁদের দলের সদস্য করে নেওয়া যায় কি না। কিন্তু ব্রিটিশদের দেহভাষায় বুঝলাম, তা তাঁরা চান না। অগত্যা আমিন সাইয়াক নামে এক রোহিঙ্গা বংশোদ্ভূত থাই নাগরিকের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হলো। ২০০০ বাথেই ফিক্সার পাওয়া গেল, যাঁরা আমাকে গণকবর বা ক্যাম্পগুলোর কাছাকাছি নিয়ে যাবেন।
জঙ্গলের বন্দী
আমিন সাইয়াক একজন দোভাষী। নৌকায় আসা মানুষ পুলিশের হাতে পড়লে সাইয়াকের ডাক পড়ে। তিনি পুলিশের তালিকাভুক্ত দোভাষী। ফলে, এবার আমার কপাল খুলল। সাংবাদিক পরিচয় দূরে রাখার জন্য হোটেলেই ফেলে এলাম পরিচয়পত্র। থানা, ডিটেনশন ক্যাম্প বা জেলখানায় সাইয়াকের ছিল অবাধ যাতায়াত। ফিক্সারকে দূরে রেখে সাইয়াক আমাকে নিয়ে যেতেন বন্দিশালাগুলোতে। আমাকে দেখিয়ে পুলিশদের বলতেন, বাংলাদেশি পর্যটক আমি। বন্দী বাঙালিদের খবর পেয়ে এখানে এসেছি। তাদের ঠিকানা লিখে নিয়ে যাচ্ছি, যদি তাদের অভিভাবকদের জানাতে পারি। এই কর্মটি সম্পাদন করতে আমাদের কিছু চাতুরির আশ্রয় নিতে হতো। হাতে নিতে হতো কিছু খাবার-দাবার। আর বন্দিশালার দ্বাররক্ষীর হাতে গুঁজে দেওয়ার জন্য হাতে রাখতে হতো ৫০০ বাথ। এই শেষটির কারণে বেঁচে যাওয়া বাঙালি আর রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য পাওয়া যেত অনেক সময়।
হাজ্জাই পুলিশ স্টেশনে ১২ জন বাংলাদেশি তরুণের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সেখানে হঠাৎ এসে হাজির হলো এক মেয়ে। বয়স বলল কুড়ি। কিন্তু দেখে মনে হলো না সতেরোর বেশি হবে। রূপসী এই মেয়েটি এসেছে নারকেল তেল আর সাবান চাইতে। মেয়েটির জীবনের কাহিনি শুনে আমি বিস্মিত! মালয়েশিয়ায় আছে তার হবু স্বামী। দালালদের সঙ্গে ৫০০০ রিঙ্গিতে (১ লাখ ১০ হাজার টাকা) রফা করেছে, হবু স্ত্রী আর নিজের বাবাকে মিয়ানমার থেকে মালয়েশিয়ায় পৌঁছে দেবে। কিন্তু থাইল্যান্ডে এসে দালালেরা তাঁদের কাছ থেকে আরও ৫০০০ রিঙ্গিত দাবি করেছে। এই বাড়তি টাকা জোগাড় করা সম্ভব হয়নি হবু স্বামীর পক্ষে। তাই বাবাকে দালালেরা পৌঁছে দিয়েছে মালয়েশিয়ায়, আর মেয়েটিকে বন্দী করে রেখেছে। এরপর মেয়েটি উদ্ধার হয়ে রয়েছে এখানে। কে আর তার খবর রাখে।
খোঁজখবর নিয়ে জানলাম, আগে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গারাই বেশি যেত। ইদানীং বাঙালিদের নেওয়ার ব্যাপারে দালালেরা উৎসাহী। কারণ, রোহিঙ্গাদের আটকে রেখে মুক্তিপণ কীভাবে আদায় করবে তারা? রোহিঙ্গাদের তো কিছুই নেই। তাই বাঙালিদের নিয়ে যায়, থাইল্যান্ডে পৌঁছানোর পর বাড়িতে খবর যায় মুক্তিপণ দেওয়ার।

থাইল্যান্ডের জঙ্গলে আবিষ্কৃত গণকবর
থাইল্যান্ডের জঙ্গলে আবিষ্কৃত গণকবর

যে পথে মানবপাচার
মানব পাচারের এই রুটটি দিয়ে বহু আগে থেকেই মানুষ পাড়ি জমাচ্ছে ভিনদেশে। মূল লক্ষ্য মালয়েশিয়া। বাংলাদেশেই ছড়িয়ে আছে দালালেরা। তারা নানাভাবে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করে মানুষদের। মাঝেমধ্যে পাচারের কাহিনি ওঠে পত্রিকায়, তারপরও পঙ্গপালের মতো কেন যায় মানুষ? প্রশ্নটি রেখেছিলাম হাজ্জাই পুলিশ স্টেশনে এক যুবকের কাছে। সে বলল, দালালেরা নাকি বলে, পত্রিকায় এসব বানানো খবর। চাকরির অন্বেষণে থাকা মানুষের কাছে দালালের তথ্যকেই বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়, পত্রিকার খবর নয়। দুই ধরনের মানুষ সাগরপথে বিদেশে পাড়ি জমায়। একদল ২ লাখ ২০ হাজারের মতো টাকা আগেই দালালকে দেয়। অন্য দল মালয়েশিয়ায় পেঁৗছে টাকা দিলে হবে, এমন বিশ্বাসে দালালদের খপ্পরে পড়ে। কাউকে কাউকে আবার বলা হয় মালয়েশিয়ায় চাকরি পাওয়ার পর কিস্তিতে টাকা শোধ করতে পারবে। এরপর থাইল্যান্ডের জঙ্গলে আটকে ফোন করা হয় আত্মীয়স্বজনকে। মুক্তিপণ ছাড়া মুক্তি মেলে না কারও।

জঙ্গলের ভেত​ের বন্দিশালা
জঙ্গলের ভেত​ের বন্দিশালা

টেকনাফ থেকে ছোট্ট নৌকায় ওঠানো হয় দলটিকে। সেখান থেকে গভীর সমুদ্রে নিয়ে ওঠানো হয় ট্রলারে। আগে যারা টাকা দিয়ে এসেছে, তাদের কিছু করা হয় না, কিন্তু যারা ভবিষ্যতে টাকা দেবে, তাদের নির্যাতন শুরু হয় এখান থেকেই। দুই মাস এই ট্রলার থাকে সমুদ্রে। তারপর আবার ছোট নৌকায় করে থাইল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলে জঙ্গলে নামিয়ে দেওয়া হয়। তারপর কখনো হাঁটিয়ে কখনো গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয় জঙ্গলে। এখানে মারধর করা হয় সবাইকেই। যারা টাকা দিয়ে এসেছে, তাদের কাছ থেকে আরও ৩০-৪০ হাজার টাকা উপরি আদায় করা হয় মারধর করে। যারা পরে টাকা দেবে এমন সত্ত্বে নৌকায় উঠেছিল, তাদের পিটিয়ে ফোনে দেশে যোগাযোগ করা হয়। টাকা এলে মালয়েশিয়ায় পৌঁছে দেওয়া হয়, নইলে পরিণতি এই ক্যাম্পে বন্দি থাকা এবং মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা।
আমার ১৩ দিনের অনুসন্ধানে মানব পাচারের এমন অনেক ভয়ংকর তথ্য দক্ষিণ থাইল্যান্ডের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে পেয়েছি। প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে শুনেছি রোমহর্ষক সব ঘটনার বর্ণনা। সেসব যেকোনো ভয়াল ছবির কাহিনিকেও হার মানায়। এর মধ্যে ঢাকায় ফিরেছি। কিন্তু এখনো বন্দিশালার সেসব মানুষদের করুণ মুখ, অসহায় চাহনি চোখে ভাসে।