মুক্তা মণ্ডলের কণ্ঠে হারানো বিজ্ঞপ্তি

নিজের দোকানে বসে হারানো বিজ্ঞপ্তির জন্য কণ্ঠ দিচ্ছেন মুক্তা মণ্ডল
ছবি: ছুটির দিনে

‘একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি, একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় একটি ছাগল হারিয়ে গেছে। ছাগলটির গায়ের রং হরিদ্রা, দুচোখের পাশে সাদা ডোরা দাগ রয়েছে।...যদি কোনো হৃদয়বান ব্যক্তি ছাগলটির সন্ধান পান, তাহলে চৌরাস্তা বাজারে মুক্তা মণ্ডলের দোকানে ফেরত দেওয়ার অনুরোধ করা হলো। সন্ধানদাতাকে পুরস্কৃত করা হবে।’

ভ্যানে বসানো মাইকে একটানা বেজে চলেছে এমন হারানো বিজ্ঞপ্তি, তবে সেখানে চালক ছাড়া কেউ নেই। পুরো ঘোষণাটি রেকর্ড করা। ধারণ করা কণ্ঠ চৌরাস্তার দোকানদার মুক্তা মণ্ডলের। হারানো ছাগলের মালিকের অনুরোধে ঘোষণা রেকর্ড করে দিয়েছেন।

শুধু এমন বিজ্ঞপ্তি নয়, কারও জানাজা, কোথাও ধর্মীয় অনুষ্ঠান কিংবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান—গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার মনোহরপুরসহ আশপাশের কয়েকটি ইউনিয়নে মাইকিং করে কোনো খবর জানানোর দরকার পড়লেই ডাক পড়ে মুক্তার। তিনিও উৎসাহ নিয়ে কণ্ঠ দেন। সম্মানী সাধলেও কারও কাছ থেকে কোনো অর্থ নেন না। তবে কেউ যদি পান খাওয়াতে চান, তাতে না করেন না।

প্রায় পাঁচ বছর ধরে ‘মাইকিংশিল্পী’ হিসেবে কাজ করে আসছেন মুক্তা। তাঁর বাড়ি পলাশবাড়ীর ঘোড়াবান্ধা গ্রামে। ঘোড়াবান্ধা চৌরাস্তা বাজারে তাঁর লোহালক্কড়ের দোকান। নিয়মিত মাইকিং করার পাশাপাশি মুক্তা করোনা মহামারির শুরুর দিকে প্রায় দুই মাস নিজের টাকায় মাইক ভাড়া করে দোকানের সামনে টাঙিয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রমও চালিয়েছেন। করোনার হালনাগাদ তথ্য প্রচারের পাশাপাশি মহামারি প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে মানুষকে নিয়মিত জানিয়েছেন তিনি।

১৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বাজারে নিজের দোকানে বসে গল্পে গল্পে মুক্তা জানালেন, লোকজন শুধু হারানো গরু-ছাগলেরই মাইকিং করাতেই তাঁর কাছে আসেন না; মূল্যবান মানিব্যাগ, দলিল-দস্তাবেজ থেকে শুরু করে পরীক্ষার প্রবেশপত্র, সনদসহ বিভিন্ন বস্তুর খোঁজে মাইকিং করান অনেকে। যত সামান্যই হোক, মানুষের এটুকু উপকারে আসতে পারলেই তাঁর তৃপ্তি লাগে।

ঘোড়াবান্ধার পাশের কুমারগাড়ী গ্রামের আবদুর রাজ্জাকের চাকরির পরীক্ষার সাক্ষাৎকার ছিল গত মার্চে। তাড়াহুড়ো করে ইজিবাইকে চড়ে জেলা সদরে পৌঁছে দেখেন, সঙ্গে সনদের ফাইলটি নেই। এখন কী করার! হঠাৎ মাথায় আসে মুক্তা মণ্ডলের কথা। দ্রুত মুক্তাকে দিয়ে রেকর্ড করিয়ে মাইক ছেড়ে দেন। আবদুর রাজ্জাকের সৌভাগ্য, মাইকে মুক্তার ঘোষণা অল্প সময়ের মধ্যেই এক ব্যক্তি ফাইলটি ফেরত দিয়ে যান। ওই সাক্ষাৎকারে তাঁর চাকরিটিও হয়। আবদুর রাজ্জাক বলেন, সে সময় সার্টিফিকেটগুলো দ্রুত ফেরত না পেলে ভাইভা বোর্ডে তিনি কী বিপাকে পড়তেন, তা কল্পনাও করতে পারেন না।

মুক্তা পাঁচ বছরে কয়েক শ হারানো বিজ্ঞপ্তির ঘোষণা দিয়েছেন। সেদিন সন্ধ্যায় মুক্তা মণ্ডলের দোকানের পাশে ততক্ষণে অনেকেই জড়ো হয়েছেন। তাঁরাও মাথা এপাশ-ওপাশ দুলিয়ে এই মাইকিংশিল্পীর দাবির সারবত্তায় সায় দিলেন।