‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাই’

মার্কিন সাংবাদিক ড্যান কগিনের একটা প্রতিবেদন পড়ে প্রথম কুষ্টিয়া যুদ্ধের কথা জানতে পারেন অনিন্দ আতিক। সিদ্ধান্ত নেন, বিষয়টা নিয়ে একটা প্রামাণ্যচিত্র বানাবেন। ছবিটা বানাতে গিয়ে চাকরি খুইয়েছেন, তারপরও সংকল্প থেকে পিছু হটেননি প্রবাসী এই নির্মাতা। দীর্ঘ সময় নিয়ে গবেষণা করেছেন, দুর্লভ আলোকচিত্র ও ফুটেজ সংগ্রহ করেছেন, নিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শী, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সমরনায়কদের সাক্ষাৎকার। অবশেষে শেষ হয়েছে সেই ছবির কাজ। রাজধানীর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে আজ দেখানো হবে দ্য ব্যাটল অব কুষ্টিয়া। ছয় বছর ধরে বানানো প্রামাণ্যচিত্রটির নেপথ্য গল্প বললেন অনিন্দ আতিক

শুটিংয়ের মুহূর্ত
ছবি: সংগৃহীত

ঐতিহাসিক এক মুহূর্তে আপনার ছবিটির উদ্বোধনী প্রদর্শনী হচ্ছে...

অনিন্দ আতিক: এ বছর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বিজয়ের ৫০ বছর, ঐতিহাসিক মুহূর্তই বটে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ৯ থেকে ১৬ ডিসেম্বর বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। সে অনুষ্ঠানমালায় আজ বিকেল পাঁচটায় ব্যাটল অব কুষ্টিয়া প্রদর্শনী।

‘ব্যাটল অব কুষ্টিয়া’ নির্মাণে আগ্রহী হলেন কেন?

আতিক: আমার জন্ম কুষ্টিয়ায়। ১৯৯৪ সালে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় মা-বাবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাই। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সেভাবে জানতাম না। ঘটনাচক্রে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক ও চলচ্চিত্রকার মানজারে হাসীন মুরাদের সঙ্গে পরিচয়। তিনিই আমাকে বর্ষীয়ান আলোকচিত্রী আবদুল হামিদ রায়হানকে নিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র তৈরি করতে বলেছিলেন। সেটা ২০১০ সালের কথা। আবদুল হামিদ রায়হানকে নিয়ে কাজ করছি। ইন্টারনেটে ১৯৭১ সালের তথ্য-উপাত্ত ঘাঁটছি। তখনই পেলাম ড্যান কগিনের প্রতিবেদনের খোঁজ। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের কুষ্টিয়া প্রতিরোধ নিয়ে মার্কিন সাংবাদিক ড্যান টাইম সাময়িকীতে লিখেছিলেন ‘পাকিস্তান: ব্যাটল অব কুষ্টিয়া’। সাড়াজাগানো সেই প্রতিবেদন আমাকে আলোড়িত করে।

তারপর...

আতিক: কুষ্টিয়ার মানুষ হিসেবে এলাকার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে আগ্রহী হয়ে উঠলাম। বই পড়লাম। একেকটি বই আরও অনেক বইয়ের সূত্র ধরিয়ে দিচ্ছিল। আমি রীতিমতো গবেষণা শুরু করলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের।

নির্মাতা অনিন্দ আতিক
ছবি: সংগৃহীত

প্রামাণ্যচিত্রটায় কী আছে?

আতিক: কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা নিয়ে বৃহত্তর কুষ্টিয়া অঞ্চল। প্রামাণ্যচিত্রে এই অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। চারটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে, যা তুলে ধরতে কুষ্টিয়া প্রতিরোধযুদ্ধের অন্যতম নায়ক লে. কর্নেল (তখন মেজর) এম এ ওসমান চৌধুরীসহ অনেক মানুষের সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছে। তাঁদের অভিজ্ঞতায় শুধু যুদ্ধই নয়, ফুটে উঠেছে স্থানীয় অনেকের বীরত্বগাথা, নেপথ্যের গল্প, পাকিস্তান হানাদার বাহিনী আর রাজাকারদের বর্বরতার করুণ চিত্র। যেমন প্রামাণ্যচিত্রের শুরুতে একজন নারীর সাক্ষাৎকার রয়েছে। তাঁর নাম দরিয়া বেগম। কুষ্টিয়া সদর থেকে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূরের বংশীতলা এলাকার ছলিম উদ্দিন বিশ্বাস চেয়ারম্যানের স্ত্রী তিনি। মুক্তিযুদ্ধে এই চেয়ারম্যান পরিবারের ছিল বিশেষ ভূমিকা। মুক্তিযোদ্ধা থেকে শরণার্থী, যাঁরাই ওই পথে যেতেন, তাঁরাই ‘ট্রানজিট পয়েন্ট’ হিসেবে ছলিম উদ্দিন বিশ্বাসের বাড়িতে অবস্থান করতেন। দরিয়া বেগম এই মানুষদের রান্না করে খাওয়াতেন। বংশীতলায় যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছিল, সে যুদ্ধে দরিয়া বেগমের মেয়েরাও মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র পৌঁছে দিয়েছিল। এর জেরে তাঁদের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রামাণ্যচিত্রের কাজ করতে গিয়ে এমন করুণ গল্প আরও শুনেছি। তবে দরিয়া বেগমের মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা বিশেষভাবে মনে থাকবে।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসে কাজ করতে সমস্যা হতো না?

আতিক: শুটিং করেছি তিনটি পর্বে। শুরুতে ২০১৩ সালে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে আসতাম বেশ সময় নিয়ে। প্রথমবার এসেছিলাম ছয় মাসের জন্য। তখন আমি একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় চাকরি করি। এত সময় তো ছুটি পাওয়া সম্ভব নয়। স্বাভাবিকভাবেই চাকরি হারালাম। এরপর এসেছি ২০১৫ ও ২০১৭ সালে। ক্যামেরা কাঁধে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর জেলার পথে পথে ঘুরেছি। একবার টানা আড়াই মাস ঘুরেছি। যাঁকে পেয়েছি, তাঁরই সাক্ষাৎকার নিয়েছি। বেশি মানুষের সাক্ষাৎকার নেওয়ার ফলে একজনের বক্তব্যের সঙ্গে অন্যজনের বক্তব্য মিলিয়ে নিতে সুবিধা হয়েছে।

কুষ্টিয়া হাইস্কুল মাঠে জমায়েত, ২৩ মার্চ ১৯৭১
ছবি: আবদুল হামিদ রায়হান

আর্থিক বিষয়ও তো ছিল...

আতিক: মন থেকে কোনো কাজ করতে চাইলে অর্থের সংস্থান হয়ে যায়। প্রথমবার নিজের উদ্যোগেই এসেছিলাম। দ্বিতীয়বার দেশে এসে কাজ করতে সহায়তা করেছিল আমার স্ত্রী অনিকা হক। সে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুদান সংগ্রহ করেছিল। তৃতীয় দফায় সাইফুদ্দিন আহমেদের সহায়তা পেয়েছি। আসলে আমি নিজে সব কাজ করেছি, এ জন্য বাড়তি সুবিধা পেয়েছি। গবেষণা, ক্যামেরা, সম্পাদনা, শব্দ সংযোজন—সবই নিজেই করেছি।

ড্যান কগিনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল কি?

আতিক: জি, ড্যান কগিনের সঙ্গে একসময় আমার বেশ বন্ধুত্বও হয়েছিল। সান ফ্রান্সিসকোতে থাকতেন। তাঁর মুখে যুদ্ধদিনের অনেক গল্প শুনেছিলাম। বাংলাদেশে আসার খুব ইচ্ছা ছিল ড্যান কগিনের। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর থেকে উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। এর মাঝেই তিনি মারা যান।

প্রামাণ্যচিত্র তো তৈরি হলো, এখন আপনার লক্ষ্য কী?

আতিক: লক্ষ্য একটাই, প্রামাণ্যচিত্রটি নিয়ে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানো। কুষ্টিয়াবাসীকে দেখানো। বিশেষ করে তরুণ যারা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তাদের কাছে প্রামাণ্যচিত্রটি পৌঁছাতে চাই। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের আগ্রহী করে তুলতে চাই। বিভিন্ন কারণে মহান মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদা ও ইতিহাস সম্পর্কে আমরা উদাসীন হয়ে পড়েছি। তরুণদের হৃদয়ে আমি মুক্তিযুদ্ধের গর্বের ইতিহাস পৌঁছে দিতে চাই। ভবিষ্যতেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করতে চাই।

ড্যান কগিন
ছবি: সংগৃহীত

ড্যান কগিনের ‘ব্যাটল অব কুষ্টিয়া’

‘৮০ হাজার সেনার পশ্চিম পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সঙ্গে লড়ছে চাষি আর শহুরে মানুষজন, তারই ফলে পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয়েছে তুমুল যুদ্ধ। বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, এর মধ্যে দুই লাখের বেশি সাধারণ মানুষ ভারী অস্ত্রে সজ্জিত পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নিহত হয়েছে। তবে ক্ষুব্ধ চাষিদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে সেনাবাহিনীও বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে।’

এটি কুষ্টিয়ার প্রতিরোধযুদ্ধ নিয়ে টাইম সাময়িকীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনের শুরুর অংশ। ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল প্রকাশিত ‘পাকিস্তান: ব্যাটল অব কুষ্টিয়া’ শিরোনামের এই প্রতিবেদনটি পাঠিয়েছিলেন মার্কিন সাংবাদিক ড্যান কগিন। ড্যান কগিনই প্রথম বিদেশি সংবাদদাতা, যাঁর সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল।

পঁচিশে মার্চের ভয়াল রাতে ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ছিলেন কগিন। হোটেলের জানালা দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছিলেন। অন্যান্য বিদেশি সাংবাদিকের মতো তাঁকেও পরে সে হোটেল ছেড়ে চলে যেতে হয় ভারতে। দিন কয়েকের মধ্যে অবশ্য আবার গোপনে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। কুষ্টিয়ার যুদ্ধ নিয়ে লিখেন সাড়াজাগানো একটা প্রতিবেদন। ড্যানের সেই প্রতিবেদনের নাম থেকেই অনিন্দ আতিক তাঁর প্রামাণ্যচিত্রের নাম ঠিক করেন, ব্যাটল অব কুষ্টিয়া

২০১২ সালের ২২ জানুয়ারি মারা যান ড্যান কগিন।