মুক্তিযুদ্ধে স্বামীকে হারিয়ে চম্পা সমাদ্দার নামেন জীবনযুদ্ধে

চম্পা সমাদ্দার
ছবি: অধুনা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সুখরঞ্জন সমাদ্দারকে একাত্তরের ১৪ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে, তখন তাঁর স্ত্রী চম্পা সমাদ্দার ছোট ছোট তিন সন্তানের মা। ৯ মাস ও তিন বছরের দুটি মেয়ে এবং পাঁচ বছরের একটি ছেলে। চম্পার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তাদের তিনি কীভাবে মানুষ করবেন!

চম্পা সমাদ্দার ম্যাট্রিক পাস ছিলেন। দেশ স্বাধীন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্কালীন উপাচার্য এসে বললেন, ‘এই যোগ্যতায় যে চাকরি দেওয়া যায়, সেটি দিয়ে আমি আপনাকে ছোট করতে পারব না। আপনি আবার পড়াশোনা শুরু করেন। পরে আপনাকে চাকরি দেব।’

উপাচার্যের আশ্বাসে আবার পড়াশোনা শুরু করলেন চম্পা। উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে আবার উপাচার্যের কাছে গেলেন। তিনি বললেন, এতেও হবে না, আরও পড়াশোনা করতে হবে। সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন। হাল ছাড়লেন না চম্পা সমাদ্দার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হলেন। স্নাতক করার পরে আবার উপাচার্যের কাছে গেলেন। আবার ফেরত পাঠালেন উপাচার্য, আরও পড়তে হবে। তা ছাড়া চাকরি দেওয়া যাবে না।

দিশেহারা হয়ে পড়েন চম্পা সমাদ্দার। তাঁর শ্বশুরবাড়ি বরিশালে। শ্বশুর পটুয়াখালী কলেজের শিক্ষক ছিলেন। ছেলের মৃত্যুশোকে যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই মারা যান তিনি। শাশুড়িও মারা যান। একমাত্র দেবর ছিলেন, তিনিও যুদ্ধের কিছুদিন পর মারা যান। স্বামী বেঁচে থাকতে প্রতি মাসে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৯০০ টাকা বেতন পেতেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেই ৯০০ টাকা তাঁর পরিবারকে দেওয়া অব্যাহত রেখেছিল। পরে শিক্ষকদের বেতন বাড়লেও তাঁকে সেই ৯০০ টাকাই দেওয়া হতো। এটাই ছিল তাঁর আয়ের উত্স।

আবার চম্পা স্নাতকোত্তরে ভর্তি হলেন। পাস করলেন। যে উপাচার্য চাকরি দিতে চেয়েছিলেন, তিনি চলে যাচ্ছেন শুনে চম্পা সমাদ্দার দেখা করতে গেলেন, কিন্তু উপাচার্য কিছুই বললেন না। সেখানে বসা ছিলেন বাংলা বিভাগের তত্কালীন শিক্ষক মোল্যা এবাদত হোসেন। উপাচার্যকে তিনি বিষয়টি মনে করিয়ে দিলেন। তখন উপাচার্য বললেন, চারটা প্রথম শ্রেণি না থাকলে তো শিক্ষকতার চাকরি দেওয়া যাবে না। ভেবেচিন্তে তিনি ‘হাউস টিউটর’ পদে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেন চম্পা সমাদ্দারকে। এ পদে চাকরি করে ২০০৬ সালে অবসর নিয়েছেন চম্পা সমাদ্দার।

এখন তিনি রাজশাহী নগরের শিরোইল মাস্টারপাড়ায় নিজের বাসায় থাকেন। বাসার নাম ‘স্পন্দন’। সেখানেই তাঁর সঙ্গে কথা হয়। বসার ঘরে টাঙানো রয়েছে সুখরঞ্জন সমাদ্দারের একটি বড় ছবি। বললেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এত সাংবাদিক এলেন, তাঁরা নিতে নিতে সব ছবি শেষ হয়ে গেল। পরে খুঁজতে খুঁজতে ছোট একটা ছবি পাওয়া যায়। ছেলে ঢাকা থেকে সেই ছবি বড় করে এনেছেন।

ছেলে পেশায় চিকিত্সক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে কর্মরত। মেয়ে মল্লিকা রাজশাহী পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক। আর শিউলি একজন স্কুলশিক্ষক। চম্পা সমাদ্দার বলেন, ‘সন্তানদের মানুষ করার জন্য আমি যে কষ্ট করেছি তা বর্ণনা করা অসম্ভব। ওদের নিয়ে আমি স্বাভাবিক জীবনযাপনও করতে পারিনি।’

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আয়োজনে কথা বলছেন চম্পা সমাদ্দার
ছবি: অধুনা

একাত্তরের ১৪ এপ্রিলের কথা উঠতেই আরেক দফা চম্পা সমাদ্দারের চোখ ভিজে উঠল। বললেন, কড়া নাড়ার পর দরজা খুলে দেওয়ার আগেই মিলিটারিরা লাথি মেরে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকে। তাঁর স্বামীকে সঙ্গে করে সারা বাড়ি ঘুরে দেখে। বের হয়ে যাওয়ার সময় একজন সেনাসদস্য তাঁর বড় ছেলেকে কোলে নিয়ে খাটের ওপরে বসে একটু আদর করে। তারা বের হয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠছিল। এমন সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিহারি শিক্ষক মতিউর রহমান তাদের কী যেন বললেন। ওরা ফিরে এসে তাঁর স্বামীকে ধরে নিয়ে গেল।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জেনেছেন, তাঁদের বাসায় যে ঘোষ দুধ দিতেন, তিনি গুলিবিদ্ধ লাশটি তাঁর বাসায় নিয়ে যান। রাতে বাড়ির পাশে মাটিচাপা দিয়ে পরের দিন ভারতে পালিয়ে যান। দেশ স্বাধীন হলে বসন্ত ঘোষ নিজে এসে সেই খবর দেন। পরে সুখরঞ্জন সমাদ্দারের দেহাবশেষ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে সমাহিত করা হয়। ২০১৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের (টিএসসিসি) নামকরণ করা হয় শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার ছাত্র-শিক্ষক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।

সন্তানেরা এখন সবাই প্রতিষ্ঠিত। চম্পা সমাদ্দার একা হাতে নিজের ক্যারিয়ার গড়েছেন, পড়াশোনা করিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সন্তানদের। জীবনের এই শেষ বেলায় এসে তাঁর চাওয়া, দেশটা যেন ভালো থাকে।