মুনজেরিন যে স্বপ্ন দেখেন

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ইংরেজির শিক্ষক’ হিসেবেই জনপ্রিয় মুনজেরিন শহীদছবি: জুয়েল শীল

একটা বিশাল মিলনায়তন কল্পনা করা যাক। বড় ধরনের কনসার্ট বা অপেরায় যেমনটা দেখা যায়। মঞ্চটা ঠিক মাঝখানে। ধরা যাক, সেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন মুনজেরিন শহীদ। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হেসে, হাত নেড়ে বোঝাচ্ছেন ইংরেজি ভাষার কোনো চমকপ্রদ দিক। চারদিকে গ্যালারিতে দর্শক গোল হয়ে বসা। ওপর থেকে ঝোলানো ডিজিটাল স্ক্রিন। সেখানে আরও অনেকের মুখ, অনলাইনে যাঁরা যুক্ত আছেন এই আয়োজনে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছেন সবাই।

দৃশ্যটা মুনজেরিনের কল্পনা থেকে নেওয়া। প্রশ্ন করেছিলাম, চোখ বুজে কোন দৃশ্যটা দেখতে আপনার ভালো লাগে? কিংবা ঘুমানোর আগে মনে মনে কোন ছবিটা দেখেন? একটু ভেবে মুনজেরিন এমন একটা দৃশ্যের কথাই বললেন। সঙ্গে যোগ করলেন, ‘প্রতিদিন এই কল্পনা করি, তা নয়। কিন্তু মাঝে মাঝে ভাবতে ভালো লাগে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর করে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করেছেন মুনজেরিন শহীদ। সেখানে তাঁর বিষয় ছিল অ্যাপ্লায়েড লিঙ্গুয়েস্টিক অ্যান্ড সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাকুইজিশন। আর এখন অনলাইন শিক্ষার প্ল্যাটফর্ম টেন মিনিট স্কুলের মানবসম্পদ বিভাগের দায়িত্বে আছেন। তবে সব ছাপিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ইংরেজির শিক্ষক’ হিসেবেই তিনি জনপ্রিয়।

ছোট ছোট ভিডিওতে ইংরেজিতে কথা বলার টুকটাক কৌশল শেখান মুনজেরিন
ছবি: জুয়েল শীল

ইংরেজি ভাষাসংক্রান্ত বইও লিখেছেন এই তরুণ শিক্ষক। নাম ঘরে বসে স্পোকেন ইংলিশ। ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, টিকটকে মুনজেরিনের লাখো ফলোয়ার। ছোট ছোট ভিডিওতে ইংরেজিতে কথা বলার টুকটাক কৌশল শেখান। কখনো কখনো ফেসবুক বা ইউটিউবে আইইএলটিএস–সংক্রান্ত ক্লাস নেন। টেন মিনিট স্কুলের ওয়েবসাইটেও আছে তাঁর একাধিক ইংরেজির কোর্স।

মুনজেরিন শহীদের মূল শক্তি সম্ভবত তাঁর গল্প বলার ধরন। ‘স্টোরিটেলিং’-এর দক্ষতা কীভাবে রপ্ত করলেন?

‘ছোটবেলা থেকে প্রচুর বই পড়তাম। যে গল্পটা পড়তাম, সেটা আমি আমার নিজের মতো করে বন্ধুদের বলার চেষ্টা করতাম। এ ছাড়া টেন মিনিট স্কুলে শুরুতে আমি যখন ব্লগ লেখার কাজ করতাম, তখন অন্য ইনস্ট্রাক্টরদের ক্লাস নিতে দেখেছি। মনে হয় আমি তাঁদের থেকেও অনেক বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছি।’ বলছিলেন তিনি।

মুনজেরিন মনে করেন, একটা দ্বিতীয় ভাষা জানা থাকলে মানুষ আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়
ছবি: সংগৃহীত

ছেলেবেলা থেকে ভিনদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছে ছিল মুনজেরিনের। অক্সফোর্ডের এই প্রাক্তন ছাত্রী এখন জানেন, ভিনদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মানুষ কেবল ডিগ্রি নয়, আরও অনেক কিছু নিয়ে ফেরে। ফেসবুক পোস্টে সে কথা খুব সুন্দর করে লিখেছিলেন তিনি। তাঁর লেখার অংশবিশেষ এমন, ‘একবার একটা উক্তি পড়েছিলাম। “বিমানবন্দরে মানুষ কাঁদে, কারণ যেই মানুষটা যায়, সেই একই মানুষটা আর ফিরে আসে না।” ইংল্যান্ডে বছরটা কাটিয়ে মনে হয় আমার বেলায়ও কিছুটা তেমন হয়েছে। আমি এখন আগের চেয়ে আরও মুক্ত, আরও স্বাধীন।’ দূরদেশে একা একা থাকা, খাওয়া, কেনাকাটা করা, রাত তিনটায় অক্সফোর্ড ক্যাম্পাসে নিশ্চিন্তে হেটে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা কীভাবে তাঁকে একটা অন্য মানুষ করেছে, সেটাই লিখেছেন মুনজেরিন।

কনটেন্ট বানানোর অভিজ্ঞতাও নিশ্চয়ই তাঁকে ‘অন্য মানুষ’ করেছে। শুরুতে আনাড়ি হাতে ভিডিও বানাতেন। অনলাইনের গলি-ঘুপচি চিনতেন না। ভিডিওর নিচে মানুষ দু-একটা বাঁকা মন্তব্য করলেই মনটা খারাপ হয়ে যেত। পরে মা মুনজেরিনকে বুঝিয়েছেন, ‘ওসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না তো। তুমি তোমার কাজ করে যাও।’

নারীদের জন্য যে নিজের মতো নিজের কাজ করে যাওয়াটা কঠিন, সে প্রসঙ্গও এল আমাদের আলাপে। মুনজেরিন বলছিলেন, ‘মেয়েদের বেলায় মানুষ শুধু কনটেন্টটাই দেখে না। আমি কী পরলাম, কীভাবে সাজলাম, এসবও বিচার করে। তাই একটু সচেতন থাকতে হয়। তবে ১০০টা ভালো কমেন্টের মধ্যে ১-২টা খারাপ কমেন্ট আমি গায়ে মাখি না। সেই মেকানিজম আমার মধ্যে তৈরি হয়ে গেছে।’

মুনজেরিন মনে করেন, একটা দ্বিতীয় ভাষা জানা থাকলে মানুষ আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়, নিজেকে প্রকাশ করার সুযোগ পায়। তাই সাধারণের মধ্যে ইংরেজির ভয় দূর করতে প্রতিনিয়ত কনটেন্ট বানিয়ে যাচ্ছেন। বলছিলেন, ‘আমরা তো এখনো স্রেফ ইংরেজির মৌলিক দিকগুলো শেখাচ্ছি। আরও গভীরে গিয়ে, আরও বড় পরিসরে শেখাতে চাই।’

কত বড়? সেটা নিশ্চয় তাঁর কল্পনার ছবিটাই বলে দেয়।