মেজাজ এত খারাপ কেন?

দেশের সাফল্যে গ্যালারিতে উল্লসিত দর্শকেরা। মাঠের মতোই এ উল্লাস চলে বাড়িতে, কর্মস্থলে, রাস্তাঘাটে, সব খানেই।
দেশের সাফল্যে গ্যালারিতে উল্লসিত দর্শকেরা। মাঠের মতোই এ উল্লাস চলে বাড়িতে, কর্মস্থলে, রাস্তাঘাটে, সব খানেই।

মেজাজ খুব খারাপ লাগছে, কোনোকিছু ভালো লাগে না, উফ, এটা এমন কেন হলো, ওটা এমন কেন হলো না, সবকিছু কেমন উলটাপালটা—এসব অনুভূতির সঙ্গে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। অথবা না চাইতেই কাছের মানুষের সঙ্গে এতটাই খারাপ ব্যবহার করে ফেললেন যে তাঁরা ভীষণ কষ্ট পান। পরে কেবল মনে হতে থাকবে কেন এমন করলাম, এত মেজাজ খারাপ না করলেও তো হতো!
ঠিক এমনটাই হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী খালিদ হাসানের (ছদ্মনাম) ক্ষেত্রে। ‘কয়েক দিন আগে ছোট্ট একটা বিষয় নিয়ে সবচেয়ে কাছের বন্ধুর সঙ্গে এতটাই ঝগড়া করেছি যে, বন্ধুটি আমার সঙ্গে কথাই বলতে চায়নি, শেষে আমি নিজেই দুঃখিত বলে সমস্যা সমাধান করে নিয়েছি। মাঝেমধ্যেই ছোট ছোট বিষয় নিয়ে এত খিটখিটে আচরণ করি যে এমন নানা অস্বস্তিকর সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়।’ এভাবেই নিজের সমস্যার কথা বললেন খালিদ। 
কিছু ভালো লাগে না!
আজকাল ভীষণ গরম পড়ছে। পাবলিক বাসগুলোতে একটু লক্ষ করলেই দেখা যায়, সামান্য বিষয় নিয়ে কথাকাটাকাটি যাত্রী আর চালকের সহকারীর, যাত্রীর সঙ্গে অন্য যাত্রীর। তর্কাতর্কি, এমনকি হাতাহাতি পর্যন্ত হয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় রিকশাচালক, সিএনজিচালিত অটোর চালকের সঙ্গে আরোহী, দোকানির সঙ্গে ক্রেতারা সামান্য কারণে রেগে যাচ্ছেন। একে অপরের সঙ্গে ঝগড়া করছেন। এর কারণ কী কেবলই গরম? গরমেই কী মানুষের মেজাজ খুব খিটখিটে হয়ে যায়? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিত্সা মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞানী ও সাইকোথেরাপিস্ট মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘মেজাজ খিটখিটে হওয়ার পেছনে গরম একটা কারণ হতে পারে, তবে এটা খুবই অপ্রত্যক্ষ। শৈশবের বিরূপ পরিবেশ, সহিংস আচরণ প্রত্যক্ষ করা, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিকূল পরিস্থিতি প্রভৃতি নেতিবাচক ঘটনা অনেকের মধ্যে চাপা ক্ষোভ, হতাশা, নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে, যার ফলে অসহিষ্ণু আচরণ, খিটখিটে মেজাজ ইত্যাদি গড়ে ওঠে।’

পরিবারেও দেখা যায় এমন অনেক ঘটনা, যেখানে পরিবারের কর্তা অফিস থেকে ফিরে স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে কারণে-অকারণে খিটমিটে আচরণ করছেন, কিংবা ছেলেমেয়েরা বাবা-মা বা পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে কোনো না-কোনো কারণে মেজাজ খারাপ করছে প্রতিনিয়ত। ফলে বাড়ছে তিক্ততা ও দূরত্ব। সম্পর্ক হয়ে যাচ্ছে যাচ্ছেতাই; যার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে শিশুদের ওপর।

এ প্রসঙ্গে মনোবিজ্ঞানী মাহমুদুর রহমান বলেন, একটা শিশু ছোটবেলায় যা দেখবে সে তা-ই শিখবে। ছেলে যদি বাবাকে সব সময় খিটখিট মেজাজে দেখে, তার মধ্যেও বড় হলে এ ধরনের আচরণ বাড়বে; যা অনেক ক্ষেত্রেই বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। পাশাপাশি আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও মারাত্মক ঝুঁকির কারণ হতে পারে। অনেকের মধ্যে বিষণ্নতা, অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার (অতিমাত্রায় উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তাজনিত মানসিক সমস্যা), পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার (অস্বাস্থ্যকর চিন্তন ও আচরণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত মানসিক সমস্যা) ইত্যাদি মানসিক রোগগুলো দেখা যায়।

মন-মেজাজ ভালো রাখতে হলে

তীব্র যানজট কিংবা কোনো কারণে গাড়ির স্বল্পতায় অসহায় হয়ে যায় নগরবাসীরা। কারণে, অকারণে মেজাজ খারাপ হয়ে ওঠে অনেকেরই।
তীব্র যানজট কিংবা কোনো কারণে গাড়ির স্বল্পতায় অসহায় হয়ে যায় নগরবাসীরা। কারণে, অকারণে মেজাজ খারাপ হয়ে ওঠে অনেকেরই।


সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে পরিবেশদূষণের মাত্রা। দিন দিন বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ প্রভৃতি বেড়েই চলছে। এর প্রভাব পড়ছে মানুষের মনোজগতে। প্রত্যেক মানুষ নিজ নিজ অবস্থানের ভিত্তিতে একটি শান্তিপূর্ণ ও আরামদায়ক পরিবেশ চিন্তা করে। যখন এর পরিবর্তে অস্বাস্থ্যকর ও কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে দিনের পর দিন জীবন অতিবাহিত করে, তখন তাঁদের মধ্যে অসহিষ্ণু আচরণগুলো অনেক বেশি প্রকট হয়ে ওঠে। এমনটাই মনে করেন মনোবিজ্ঞানী মাহমুদুর রহমান। তাঁর মতে, খিটখিটে মেজাজ অথবা অসহিষ্ণু আচরণের কোনো সমাধান নেই, যদি না আপনি নিজেই নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর কিছু পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শ হচ্ছে—
১. পরিবেশ মানুষের মনকে অনেক প্রভাবিত করে, সুস্থ পরিবেশ মনকে শান্ত রাখে। সব পরিবেশে মনকে শান্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে এবং সবাইকে যথাসম্ভব স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখতে চেষ্টা করতে হবে।
২. নিজের মধ্যে ইতিবাচকতা সৃষ্টি করতে হবে, অন্যের চিন্তা ও আচরণকে শ্রদ্ধা করার মনোভাব তৈরি করতে হবে। নেতিবাচক আচরণগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলো দূর করার চেষ্টা করতে হবে। 
৩. চাপা অনুভূতি, ক্ষোভ প্রভৃতি বিষয় খিটখিটে মেজাজের জন্য অনেকটাই দায়ী। তাই এ বিষয়গুলো নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতে হবে পরিবার ও কাছের মানুষদের সঙ্গে।

৪. নিয়মিত শরীরচর্চা, যোগব্যায়াম করা যেতে পারে। বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা এবং পরিবারের অন্যদের জন্যও বিনোদনমূলক সময় কাটানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

৫. দৈনন্দিন কাজকর্মের ফাঁকে নিজের জন্য একটু সময় বের করুন। সারা দিন নিজের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে দেখুন আপনার অসহিষ্ণু আচরণগুলো কী কী, সেগুলো সচেতনভাবে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন।

দেশকে ভালোবাসি, মন ভালো করি

আমরা একা একা বাঁচতে পারি না, সমাজবদ্ধ হয়ে বাঁচি। ফলে আমাদের চারপাশটা ভালো না থাকলে আমাদেরও ভালো থাকার সম্ভাবনা কমে যায়। দেশের একটা ভালো খবরে আমাদের মন ভালো হয়ে যেতে পারে, খারাপ খবরে খারাপ। যখন শুনি, রাষ্ট্রে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাওয়া, সংঘাতের ঝুঁকি, স্বাস্থ্যসেবার মান, বিধিনিষেধের মাত্রা, তাপমাত্রা এবং বিদ্যালয় ও যোগাযোগব্যবস্থার বিবেচনায় সম্প্রতি ‘ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট’-এর তালিকা অনুসারে বিশ্বে বসবাসের সবচেয়ে অযোগ্য শহর নির্বাচিত হয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। এই খবরে যেমন মেজাজ খারাপ হবে, তেমনি বাস্তবে এই অস্থিরতার প্রভাব আমাদের মনের ওপর পড়াও খুব অস্বাভাবিক নয়। 

আবার আমরা দেখি, দেশের সাফল্যে, দেশের ভালো খবরে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মাঝে। ক্রিকেট খেলায় বাংলাদেশ জিতলে সমগ্র দেশের মানুষ আনন্দ উল্লাস করে। বাড়ির সবচেয়ে রাগী মানুষটার মনও ফুরফুরে হয়ে যায়। দেশ ভালো থাকলে মানুষের মন ভালো থাকে। তেমনিভাবে দেশের অস্থিরতায় মানুষের মধ্যে অসহিষ্ণু আচরণ, হতাশা ও খিটখিটে মেজাজ প্রভৃতি সৃষ্টি হওয়াও সম্ভব বটে। তাই আসুন, আমরা সবাই দেশকে আরও বেশি বেশি ভালোবাসি, দেশের জন্য ভাবি, সবাই মিলে ভালো থাকার চেষ্টা করি।