মোমবাতিতে আলোকিত তাঁদের জীবন
অনার্স ও ডিগ্রি পড়ুয়া চার ছাত্রীকে নিয়ে কিছুদিন আগেও এলাকার মানুষ হাসাহাসি করতেন। তবে এখন এলাকাবাসী গর্ব করেন। মোমবাতি তৈরি করে নিজেদের পড়াশোনার খরচ চালানোর পাশাপাশি করোনাভাইরাসের বিস্তারের পর থেকে গ্রামের অসহায় মানুষকেও নানাভাবে সহযোগিতা করছেন। এই চারজন হলেন খাগড়াছড়ির পানছড়ি যৌথ খামার মারমাপাড়া এলাকার চেউং মারমা (২২), ম্রাচিং মারমা (১৯), ডলিপ্রু মারমা (২১) ও ম্রাচাইন্দা মারমা (২২)।
পানছড়ি কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী চেউং মারমার জন্ম নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে। অভাব লেগেই থাকত। তিনি জানালেন, একদিন কলেজ থেকে ফেরার সময় বান্ধবীদের কাছ থেকে মোমবাতি তৈরির প্রশিক্ষণের খবর পান। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পরিবারে এবং বৌদ্ধবিহারে মোমবাতি একটি প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। তাই মোমবাতি তৈরি করে আয় করার চিন্তা মাথায় আসে। পরে পাড়ার অন্য তিনজনের সঙ্গে আলোচনা করেন। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মহিলা অধিদপ্তর থেকে তাঁরা মোমবাতি তৈরির প্রশিক্ষণ নেন দেড় বছর আগে।
চেউং মারমা বললেন, ‘প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর গ্রামের একজনের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নিই। আর নিজেদের কিছু জমানো টাকা নিয়ে পুরোনো একটি মেশিন কিনে মোমবাতি তৈরির কাজ শুরু করি। আমাদের আগ্রহ দেখে মহিলা অধিদপ্তরের পানছড়ি উপজেলা কর্মকর্তা মনিকা বড়ুয়া একটি মেশিন কিনে দেন। বর্তমানে আমাদের আটটি মেশিন রয়েছে। আমাদের উদ্যোগের নাম দিয়েছি ফোর ক্যান্ডেল ওয়ার্কস মুইতা আরং মৈত্রীর আলো মোমবাতি।’
ম্রাচিং মারমা জানালেন, প্রথমে পাড়ায় একটি খোলা জায়গায় পলিথিন টাঙিয়ে মোমবাতি তৈরি করতেন। বৃষ্টিতে কাজ বন্ধ রাখতে হতো। এলাকার চাইন্দা মারমা নামের এক নারী তাঁর পরিত্যক্ত একটি ঘর দেন এ কাজে ব্যবহারের জন্য। বর্তমানে ইসলামপুর এলাকায় রাস্তার পাশে (১০ হাজার টাকা সালামি দিয়ে) প্রতি মাসে এক হাজার টাকায় একটি ঘর ভাড়া নিয়েছেন।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, ১৫ ফুট দৈর্ঘ্য আর ১২ ফুট প্রস্থের টিন আর বেড়ার একটি ছোট এক রুমের ঘর। এই ঘরে বসে সবাই মিলেমিশে মোমবাতি তৈরি করছেন, প্যাকেটে ভরছেন, মোটা কাগজ দিয়ে প্যাকেট তৈরি করছেন, লেভেল লাগাচ্ছেন সুন্দর করে। তাঁরা মোম গলানো থেকে শুরু করে সুতা কাটাসহ সব কাজ নিজেরাই করেন। আগে এক বস্তা সাদা মোম বা প্যারাফিনের দাম ২ হাজার ৬০০ টাকা হলেও করোনাভাইরাসের বিস্তারের পর দাম বেড়ে চার হাজার টাকা হয়েছে। আকারভেদে প্রতিটি মোমবাতির প্যাকেট বিক্রি করেন ১০ থেকে ২০ টাকা করে। মোমবাতি তৈরির ওপর নির্ভর করে আয়।
এই চার উদ্যোক্তা জানালেন, ৫০ হাজার টাকা কিস্তি পরিশোধ করা বাকি আছে। প্রতি মাসে আট হাজার টাকা কিস্তি দিতে হয়। তবে সব খরচ বাদ দিয়ে ৪ থেকে ১০ হাজার টাকা হাতে থাকে। এখন আর পড়ালেখার খরচের কথা চিন্তা করতে হয় না। করোনার সময় চাল, ডাল দিয়ে গ্রামের প্রায় ১৭টি পরিবারকে সহায়তাও করেছেন তাঁরা।
ম্রাচাইন্দা মারমা বলেন, ‘প্রথম দিকে কলেজ থেকে এসে দিনের আলোয় যে সময়টুকু পেতাম, সেই সময়ে মোমবাতি তৈরি করতাম। সেই মোমবাতি কাঁধে নিয়ে বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করেছি। বর্তমানে আমাদের তৈরি মোমের চাহিদা বেড়েছে। প্রতি সপ্তাহে পাইকারি হিসেবে বিভিন্ন দোকানে দিয়ে আসি। অনেক গ্রাহক ফোন করেন মোমবাতির জন্য। আমরাও গ্রাহকদের অনুরোধ রাখতে যত দূর হোক না কেন মোমবাতি পৌঁছে দিয়ে আসি।’
প্রথম দিকে কলেজ থেকে এসে দিনের আলোয় যে সময়টুকু পেতাম, সেই সময়ে মোমবাতি তৈরি করতাম। সেই মোমবাতি কাঁধে নিয়ে বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করেছি। বর্তমানে আমাদের তৈরি মোমের চাহিদা বেড়েছে। প্রতি সপ্তাহে পাইকারি হিসেবে বিভিন্ন দোকানে দিয়ে আসি। অনেক গ্রাহক ফোন করেন মোমবাতির জন্য। আমরাও গ্রাহকদের অনুরোধ রাখতে যত দূর হোক না কেন মোমবাতি পৌঁছে দিয়ে আসি।
চেউং মারমা জানালেন, তাঁদের পাড়ায় ৪৫ পরিবারের বাস। এই পাড়া থেকে তিনিই প্রথম যে অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন। বাকি তিনজনও ডিগ্রি পড়ুয়া প্রথম নারী। বর্তমানে পড়াশোনার পাশাপাশি এই কাজটি করছেন বলে অনেকেই প্রশংসা করেন।
চারজনই স্বপ্ন দেখেন, তাঁদের নিজেদের ছোট একটি কারখানা থাকবে। সেই কারখানায় তাঁরা প্রশিক্ষণ দেবেন অসহায় আর প্রতিবন্ধী নারীদের। প্রশিক্ষণ পেয়ে এই নারীরাই একসময় নিজেদের পায়ে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবেন।