যবিপ্রবির যত সাফল্য
‘আমি তোমায় ভালোবাসি, জগতে হইয়াছি দোষী...’ গিটার হাতে গাইছিলেন এক শিক্ষার্থী। আরেকজন বাজাচ্ছিলেন কাহন। জনাদশেক ছাত্রছাত্রী গোল হলে বসেছেন। গানে গলা মিলাচ্ছিলেন সবাই।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (যবিপ্রবি) ক্যাম্পাসের কদমতলায় এই দৃশ্য দেখা গেল গত ৩০ মার্চ। করোনাকালের ধকল কাটিয়ে আবার গানে-আড্ডায় মুখর হয়েছে এই প্রাঙ্গণ।
ক্যাম্পাসের বিশাল মাঠে তখন মঞ্চ সাজানো চলছে। মঞ্চের পাশে বড় বড় সাউন্ড বক্স রাখা হয়েছে। নির্মাণাধীন ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তনের বিভিন্ন কক্ষে চলছিল শিক্ষার্থীদের নাচের মহড়া। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, দুই দিনব্যাপী র্যাগ ডে উদ্যাপনের প্রস্তুতি চলছে।
পরিবেশবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সজিবুর রহমান বলেন, ‘দুই মাস ধরে ক্যাম্পাসে যেন ঈদের আনন্দ। ঘরবন্দী জীবন থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি। ক্যাম্পাসে একের পর এক বড় বড় অনুষ্ঠান হচ্ছে। কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে চিরকুট ব্যান্ডের সদস্যরা এসেছিলেন। আরও এসেছে খুলনার ব্যান্ড, পথের বাউল। আমাদের ক্যাম্পাসের ব্যান্ড ক্রাউড তো ছিলই। খোলা মঞ্চে সারা রাত আমরা গান শুনেছি। এখন আবার দুই দিনের র্যাগ ডে আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে।’ পুরো ক্যাম্পাসেই এই উৎসব মুখর টের পাওয়া গেল।
ক্যাম্পাসে সক্রিয় ৩০ ক্লাব
নাটক, গান, আবৃত্তি, বিতর্ক, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ, শখের ফটোগ্রাফি, খেলাধুলা—সবকিছুতেই আছেন যবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা। সৃজনশীল এসব কার্যক্রম চর্চার জন্য ক্যাম্পাসে ছাত্র নির্দেশনা দপ্তর অনুমোদিত ৩০টির বেশি ক্লাব আছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পিঠা উত্সব, একুশের আলপনা, বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে সাজসজ্জা, বিতর্ক প্রতিযোগিতাসহ নানা আয়োজনে ক্লাবগুলো নেতৃত্ব দেয়। বিবর্তন, বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নাট্যকর্মীরা ইতিমধ্যে তিনটি নাটক প্রযোজনা করে ক্যাম্পাসে পাঁচবার মঞ্চস্থ করেছেন। সাংস্কৃতিক সংগঠন ও বিতর্কের ক্লাব সরব থাকে সারা বছর। এ ছাড়া ফটোগ্রাফি সোসাইটি, সিনে প্রজন্মের ব্যানারে শিক্ষার্থীরা ছবি তোলা ও তথ্যচিত্র তৈরির কাজ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৬টি বিভাগের মধ্যে অন্তত ২০টি বিভাগের নিজস্ব ক্লাব আছে। বিভাগের সব ধরনের অনুষ্ঠান এই ক্লাবের মাধ্যমেই হয়।
ক্লাবগুলো সক্রিয় থাকলেও ক্যাম্পাসে ক্লাব সদস্যদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো কক্ষ নেই। যে কারণে শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসের এখানে-সেখানে নাটক বা নাচের মহড়া করতে হয়। এ প্রসঙ্গে ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক আলম হোসেন বলেন, ‘ক্যাম্পাসে টিএসসি ভবন নির্মাণ প্রায় শেষের দিকে। ভবনের নিচতলায় ক্লাবগুলোর জন্য ঘর থাকবে। ক্লাবের কর্মকাণ্ডের ওপর ভিত্তি করে প্রথমে ১০টি ক্লাবের জন্য ঘর বরাদ্দ করা হবে। আমাদের এখানে ক্লাবগুলোর কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়। সক্রিয় ও ভালো কর্মকাণ্ডের জন্য ক্লাবের কর্মীদের পুরস্কার দেওয়া হয়।’
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলোয়াড়দের সাফল্য
চার ঘণ্টা পাঁচ মিনিটে সাঁতরে বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করা প্রথম নারী সাঁতারু মিতু আকতার যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে তিনি এই রেকর্ড সৃষ্টি করেন। একই বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী খাদিজা আকতার ২০১৯ সালে নেপালে অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান গেমস ও ২০১৮ সালে এশিয়ান গেমসে সাঁতারে অংশ নেন। প্রতিযোগিতায় উল্লেখযোগ্য কোনো অবস্থান না পেলেও বেস্ট টাইমিংয়ের খেতাব অর্জন করেন তিনি।
২০২১ সালে জাপানের টোকিও অলিম্পিকে বাংলাদেশের হয়ে অ্যাথলেটিক ডিসিপ্লিনে ৪০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেন জহির রায়হান। জহিরও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের শিক্ষার্থী। মাস্টার্সের শিক্ষার্থী উজ্জ্বল চন্দ্র সূত্রধর ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত জাতীয় অ্যাথলেটিক প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার দীর্ঘ লাফে অংশ নিয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেন। এ ছাড়া জাতীয় নারী হকি দলের বর্তমান অধিনায়ক রিতু খানম, জাতীয় হকি দলের সদস্য সরোয়ার মোর্শেদ ও আল নাহিয়ান এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থী।
২০২২ সালে বঙ্গবন্ধু ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ম্যারাথনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ ক্যাটাগরিতে যবিপ্রবির ছাত্র মো. আল আমিন দ্বিতীয় রানারআপ ট্রফি অর্জন করেন। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের ১১টি দেশের খেলোয়াড়েরা অংশ নিয়েছিলেন।
গবেষণায় সাফল্য
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৬টি বিভাগেই কোনো না কোনো গবেষণা আছে। গবেষণা না থাকলে শিক্ষকদের পদোন্নতি হয় না। তাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগে গবেষণা অনেকটা বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে। বিশ্বের নামী জার্নালে এখানকার গবেষণা প্রকাশ পাচ্ছে।
অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ইকবাল কবীর জাহিদের নেতৃত্বে একদল গবেষক পোলট্রিশিল্পের জন্য অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসেবে নতুন একটি প্রোবায়োটিক উদ্ভাবন করেছেন। গবেষক দলটি দেখিয়েছে, পোলট্রিশিল্পে অ্যান্টিবায়োটিকের চেয়ে তাদের উদ্ভাবিত প্রোবায়োটিক বেশি কার্যকর, লাভজনক, স্বাস্থ্যসম্মত এবং পরিবেশবান্ধব।
কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জাভেদ হোসেন খানের নেতৃত্বে শিক্ষার্থীরা কৃষিকাজে ব্যবহৃত গতানুগতিক সারের বিকল্প হিসেবে ন্যানো সার ও মাছ চাষে ব্যবহৃত বাজারের গতানুগতিক খাবারের বিকল্প ন্যানো খাবার উদ্ভাবন করে সফলতা পেয়েছেন। ঢ্যাঁড়স, মরিচ, লেটুস, বেগুনসহ সবজিতে ন্যানো সার, তেলাপিয়া মাছসহ কার্প-জাতীয় কিছু মাছে ন্যানো খাবারের ব্যবহার করে গবেষণায় সফলতা এসেছে। গবেষণায় সফলতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে গবেষক জাভেদ হোসেনকে স্বর্ণপদকও দেওয়া হয়েছে।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের স্বাদুপানির দ্বিতীয় বৃহত্তম হ্যাচারি স্থাপন করা হয়েছে। হ্যাচারিতে প্রতিবছর ১৫০ থেকে ২০০ কেজি রুই, কাতলা, শিং, পাবদাসহ সাদা মাছের রেণু ও পোনা উৎপাদন করা হচ্ছে। দেশের সাধারণ মাছচাষিরা এখান থেকে গুণগত মানসম্পন্ন মাছের রেণু ও পোনা কিনতে পারবেন। বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সেলের উপদেষ্টা মনজুরুল হক বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির আগে এই হ্যাচারিতে একবার পরীক্ষামূলকভাবে মাছের রেণু ও পোনা উৎপাদন করা হয়। মধ্যে দুই বছর বন্ধ ছিল। এপ্রিল মাসে আবার রেণু উৎপাদন শুরু হবে। এখন বছরে ১৫০ থেকে ২০০ কেজি রেণু উৎপাদনের সক্ষমতা আছে। পুকুরের সংখ্যা বাড়ানো হলে এক হাজার কেজি রেণু ও পোনা উৎপাদন করা সম্ভব। এতে দেশের মাছচাষিদের জন্য গুণগত মানসম্পন্ন পোনা সংগ্রহের সুযোগ সৃষ্টি হবে।’
দেশে-বিদেশে ভালো অবস্থানে শিক্ষার্থীরা
যবিপ্রবি থেকে লেখাপড়া শেষ করে অনেক শিক্ষার্থী দেশ-বিদেশে ভালো অবস্থানে আছেন। শতাধিক ছাত্রছাত্রী বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানি, মালয়েশিয়া, কানাডাসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গবেষণার সঙ্গে যুক্ত আছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা, পুলিশ ও প্রশাসনের উচ্চপদে চাকরিসহ নানা ক্ষেত্রে ছড়িয়ে আছেন এখানকার প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এই বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিকভাবে গবেষণায় আমাদের সুনাম আছে। ইতিমধ্যে আমাদের সব গবেষণা নিয়ে একটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়েছে। কয়েকজন বিদেশিকেও সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়া হয়েছে।’